নিজস্ব প্রতিবেদক: সাওম বা সিয়াম শব্দটি আরবি। বাংলা ভাষায় এর প্রতিশব্দ হলো রোজা। ফার্সি ভাষায় ও সাওমকে রোজা বলা হয়। আরবি সাওম শব্দের অর্থ বিরত থাকা, দূরে থাকা, কঠোর সাধনা করা, অবিরাম চেষ্টা ও আত্মসংযম করা। ইসলামী পরিভাষায় সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার নিয়তের সাথে সকল প্রকার পানাহার ও যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোজা বলা হয়। যে পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম ধর্মের বুনিয়াদ বা ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত তন্মধ্যে রোজা অন্যতম।
নবী করিম (সা.) নবুওয়াতের ত্রয়োদশ সালে মদিনায় হিজরতের পর তথাকার ইহুদিদের মধ্যে আশুরার রোজা পালন করতে দেখে মুসলমানদেরকে উক্ত দিনের রোজা পালন করতে নির্দেশ দেন এবং নিজেও রোজা পালন করেন। হিজরতের আঠার মাস পর কিবলাহ পরিবর্তনের পর শাবান মাসে রমজান মাসের রোজা ফরজ হবার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নাজিল হয়। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : হে মুমিনগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। (সূরা বাকারাহ : ১৮৩)।
এই আয়াত নাজিল হবার পর আশুরার রোজা পালনের অপরিহার্যতা নাকচ হয়ে যায় এবং রমজান মাসের রোজা রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। প্রত্যেক বয়ঃপ্রাপ্ত, সুস্থ মুকীম ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর ওপর রমজান মাসের রোজা রাখা ফরজ। তবে, সঙ্গত কারণে উক্ত মাসে রোজা না রাখতে পারলে পরবর্তী সময়ে তা কাজা করা ফরজ। তাছাড়া কাফফারা আদায়েরও বিধান রয়েছে। মানুষের আত্মিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে রোজা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, মুসলিমদের প্রতি সিয়াম ফরজ হওয়ার নির্দেশটি একটি বিশেষ নজির উল্লেখসহ দেয়া হয়েছে। নির্দেশের সাথে সাথে এটাও বলে দেয়া হয়েছে যে, সিয়াম শুধুমাত্র তোমাদের ওপরই ফরজ করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল। এর দ্বারা যেমন সিয়ামের বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, তেমনি মুসলিমদের এ মর্মে একটি সান্ত¦না ও দেয়া হয়েছে যে, সিয়াম একটা কষ্টকর ইবাদত সত্য, তবে তা শুধুমাত্র তোমাদের ওপরই ফরজ করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল। তারা ও তোমাদের মতো কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিল।
তবে, আগে তার উম্মতদের সিয়াম সাধনা সমগ্র শর্ত ও প্রকৃতির দিক দিয়ে উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর আরোপিত সিয়ামের অনুরূপ ছিল না বিধায় এই উভয় উম্মতের সিয়াম সাধনার রূপ রেখা এক নয়। বরং উভয় সম্প্রদায়ের সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে। মাহে রমজানের রোজা হাতে গোনা কয়েকটি দিন মাত্র। ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে এক বছর হলে মাত্র ২৯ অথবা ৩০ দিন রোজ পালন করতে হয়। এটা কঠিন কিছু আমল নয়। বরং সহজ ব্যবস্থা। আল কুরআনে একে এভাবে বিবৃত করা হয়েছে। এ রোজা গনা কয়েকদিন মাত্র।
অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য দিন গুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। আর যাদের জন্য সিয়াম সাধনা কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য হলো এর পরিবর্তে ফিদইয়া-একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃর্স্ফূতভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণের যদি তোমরা জানতে। (সূরা আল বাকারা : ১৮৪)।
এই আয়াতে কারীমায় সাওম সংক্রান্ত কয়েকটি জরুরি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যা খুবই প্রণিধানযোগ্য। যথা : প্রথমত, উল্লেখিত আয়াতে অসুস্থ বা রুগ্ন ব্যক্তি বলতে সে ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে সাওম রাখতে যার কঠিন কষ্ট হয় অথবা রোগ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দ্বিতীয়ত, সফররত-অবস্থায় সাওম না রাখা ব্যক্তির ইচ্ছা ও পছন্দের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। হযরত আনাস (রা.) বলেন, সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সফরে যেতেন। তাদের কেউ সাওম রাখতেন আবার কেউ রাখতেন না। কিন্তু উভয় দলের কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করতেন না। (সহিহ বুখারী : ১৯৪৭; সহিহ মুসলিম : ১১১৬)।
তৃতীয়ত, রুগ্ন বা মুসাফির ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় বা সফরে যে কয়টি সাওম রাখতে পারবে না, সেগুলো অন্যসময় হিসেব করে কাজা আদায় করা ওয়াজিব, যে সকল লোক সাওম রাখার পূর্ণ সামর্থ থাকা সত্ত্বেও সাওম রাখতে চায় না তাদের জন্য সাওম না রেখে সাওমের বদলায় ফিদইয়া দেয়ার সুযোগ নেই।
তবে যে সকল লোক অতিরিক্ত বার্ধক্যজনিত কারণে সাওম রাখতে অপারগ কিংবা দীর্ঘকাল রোগ ভোগের দরুণ দূর্বল হয়ে পড়েছে অথবা দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছে, সে সকল লোকের বেলায় উপরোক্ত নির্দেশটি এখনো প্রযোজ্য রয়েছে। আল্লাহপাক আমাদেরকে সিয়াম পালন করার সামর্থ দান করুন, আমীন!