দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: আবার জমবে মেলা হাট খোলা, বটতলা অগ্রানে নবান্নের উৎসবে, সোনার বাংলা ভরে উঠবে সোনায় বিশ^ অবাক চেয়ে রবে— দেশাত্ববোধ গানের সুরেই মুখরিত হয়ে প্রতিবছর অগ্রহায়ন মাসের প্রথম দিনে নবান্ন উৎসব করে থাকেন গ্রামবাংলা মানুষেরা। নতুন ধানের অন্ন হয়ে থাকে নবান্ন। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন উৎসবগুলোর মধ্যে পঞ্জিকামতে অগ্রহায়নের প্রথম দিনে একটি হলো নবান্ন উৎসব। এ উৎসব উপলক্ষে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নবান্নের আনন্দে মেতে উঠে। ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ মাছের মেলা। এসব মেলায় ক্রয়—বিক্রয় হয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। আর উৎসব উপলক্ষে মেয়ে—জামাই ও অন্যান্য আত্মীয়—স্বজনদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের পরিবেশন করা হয় বাহারি পিঠা—পায়েসসহ নানা রকমের সুস্বাদু খাবার।
এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর মাছের মেলা বসে উথলীতে। নবান্ন উৎসব শিবগঞ্জের উথলী হলেও রথবাড়ি, ছোট ও বড় নারায়ণপুর, ধোন্দাকোলা, সাদল্লাপুর, বেড়াবালা, আকনপাড়া, গরীবপুর, দেবীপুর, গুজিয়া, মেদেনীপাড়া, বাকশন, গনেশপুর, রহবল প্রায় ২০ গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে চলে উৎসব। মাছের মেলা বসে জেলার নন্দীগ্রাম উপজেলার ওমরপুর, রনবাঘা, হাটকড়ই, ধুন্দার ও দাসগ্রাম এবং শেরপুর উপজেলার বারদুয়ারীহাট, সকালবাজার, গোশাইপাড়া মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে। নবান্ন উৎসবে প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে—জামাইসহ আত্মীয়—স্বজনদের আগে থেকেই নিমন্ত্রণ করা হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে তারা নতুন ধানে নবান্ন নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠেন।
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনুযায়ী হিন্দুরা এই নবান্ন মেলার উদ্যোক্তা হলেও আশপাশের গ্রামের সকল স¤প্রদায়ের মানুষ এখানে কেনাকাটা করতে আসে। এসব মাছের মেলার কথা বলা হলেও ক্ষেত থেকে নতুন তোলা শাক—সবজির পসরাও সাজানো হয় মেলা চত্বরে।
এছাড়াও সেখানে নাগরদোলা, শিশু—কিশোরদের খেলনার দোকানও বসেছে। সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও দইয়ের একটি বড় বাজারও বসানো হয় মেলা চত্বরে।
১৭ নভেম্বর মঙ্গলবার সরেজমিনে জেলার শিবগঞ্জের উথলী, নন্দীগ্রামের উপজেলার রণবাঘা, ওমরপুর ও শেরপুরের বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধভাবে বসেছে মাছের দোকান। দোকানগুলোতে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, চিতল ও সিলভার কার্পসহ নানা প্রজাতির মাছ। এসব মেলায় এক কেজি থেকে শুরু করে ১৮কেজি ওজনের মাছ পাওয়া যাচ্ছে। তবে এবছরের মেলায় ৪০ কেজি ওজনের বিশালাকৃতির বাঘাআইড় মাছ আকর্ষণসহ বিশাল বিশাল মাছগুলো মাথার ওপরে তুলে ধরে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেও দেখা যায়। বাঘাইড়, রুই—কাতলা ও চিতল মাছগুলো ছয়শ টাকা থেকে এক হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও মাঝারি আকারের মাছ তিনশ থেকে সাড়ে ছয়শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। এছাড়া ২০০—৪৫০ টাকা দরে ব্রিগেড ও সিলভার কার্প মাছ বেচাকেনা হয়।
এছাড়া নতুন আলু বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা কেজি দরে। মিষ্টি আলু ও কেশর (ফল) প্রতি কেজি দেড়শ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
মাছ বিক্রেতা কালাই উপজেলার পুনট গ্রামের মোসলেম উদ্দিন মিয়া বলেন, মেলায় ছোট—বড় মিলে দেড় শতাধিক মাছের দোকান বসেছে। প্রত্যেক বিক্রেতা অন্তত ৬ থেকে ১০ মণ করে মাছ বিক্রি করেছেন। মেলায় মাছ সরবরাহের জন্য ২০টি আড়ত খোলা হয়। সেসব আড়ত থেকে স্থানীয় বিক্রেতারা পাইকারি দরে মাছ কিনে মেলায় খুচরা বিক্রি করেন।
উথলী মাছের মেলার পাশের নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা ভবতোষ সরকার বলেন, প্রায় দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি মেলার দিন নতুন শাক—সবজিতেও ভরপুর থাকে। এ কারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসে।
শিবগঞ্জ উপজেলার ধোন্দাকোলা গ্রামের প্রতুল কর্মকার বলেন, “আমরা ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি এই মেলা। আশপাশের এলাকা হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় নবান্নের মেলাটি জমজমাট হয়। মেলায় নবান্নের সব উপকরণওই পাওয়া যায়।”
মেলায় মাছ কিনতে এসে বেড়াবালা গ্রামের আজির উদ্দিন ও গণেশপুর গ্রামের সুখেন চন্দ্র দাস বলেন, উথলীর নবান্ন মেলায় বিক্রির জন্য আশপাশের এলাকার পুকুরগুলোতে সৌখিন চাষিরা মাছ মজুদ করে রাখেন।
একইভাবে মেলায় আগত সুবাস চন্দ্র ও হরিলাল চন্দ্র জানান, সনাতন হিন্দু স¤প্রদায়ের কৃষকরা তাদের পঞ্জিকা অনুসারে ১ অগ্রহায়ণ থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। এ নিয়মের ধারাবাহিকতায় কৃষকদের ঘরে ঘরে চলছে নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের ভাত, পিটা, নতুন নতুন তরকারি দিয়ে তারা নবান্ন উৎসব পালনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মহাস্থান হাটে বড় মাছ ও নতুন নতুন তরকারি কিনতে এসেছেন।
উথলী বহুমুখী মৎস্য আড়তের স্বত্ত্বাধিকারী ফজলুল বারীসহ একাধিক ব্যবসায়ীদের কথা বললে তারা জানান, আগে মেলাটি ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও সা¤প্রতিক সময়ে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে। শুধু আশপাশেরই নয় পুরো শিবগঞ্জ উপজেলার মানুষ এখানে নবান্নের বাজার করতে আসে। মাছের মেলার খবর পেয়ে শহর থেকেও অনেকে সেখানে ছুটে যান মাছ কিনতে। তবে তুলনামূলকভাবে এবার মাছের আমদানি অনেকটা কম বলে তিনি মনে করেন। মেলা উপলক্ষে পুরোহাট সাজানো হয়েছিল। ভোরবেলা থেকে আসতে শুরু করেন মাছ বিক্রেতারা। নানা ওজনের নানা মাছ ছিল তাদের কাছে। তবে মেলার আকর্ষণ ছিল ৪০ কেজি ওজনের বাঘাইড়। ক্রেতাদের উপস্থিতও ছিল চোখে পড়ার মতো। বাজারে শুধু যে ক্রেতাদেরই ভিড় তা কিন্তু নয়, অনেকে বড় মাছ দেখার উৎসুকে দূর—দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিলেন। ক্রেতাদের অনেকেই জানান, গতবারের চেয়ে এবার মাছের দাম একটু কম এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শিবগঞ্জের উথলী বাজারের ইজারাদার আল আমিন বলেন, প্রতি বছর এ মেলার আয়োজন করা। করোনা মহামারিতে মানুষের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে এ মেলায় গ্রামবাসী ও মাছ ব্যবসায়ীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ভালো হচ্ছে বেচাবিক্রি।
মেলায় আগত স্থানীয়রা জানান, প্রায় ২ বছরের পুরনো এ মেলায় প্রতি বছরই প্রায় কোটি টাকার মতো মাছ বেচাকেনা হয়। এবার মেলায় ৪০ কেজি ওজনের কাতলাসহ বড় বড় মাছ এসেছে মেলায়। বিক্রিও হচ্ছে ৩০০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে। মেলায় নানা জাতের বিভিন্ন ধরনের মাছ আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. বদিউজ্জামান বলেন, নবান্নের এ মেলায় যেন কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি না হয় তার জন্য পুলিশ বাহিনী সজাগ রয়েছে।