আবু রায়হান, জয়পুরহাটঃ জয়পুরহাটে আলুর বিজ পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বিজ ব্যাবসায়ীদের সিন্ডিকেটে দিশেহারা কৃষক।
বাণীজ্যিক উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বিজ উত্তোলন করে বিজয় ব্যাবসায়ীরা তাদের নির্ধারিত বিক্রয় কেন্দ্রে না এনে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার মাধ্যমে ধানের চাতাল ঘরে, নিজ বাড়িতে, তাদের অধীনস্থ কর্মচারিদের বাড়িতেসহ পার্শবর্তি অন্যত্র তাদের ভাড়া করা গোডাউনে অবৈধভাবে মজুদ করছে।
ফলে স্থানীয় কৃষকরা আলু বিজের জন্য দিনের পর দিন বিজয় ব্যাবসায়ীদের দোকানে ভোর রাত থেকে সারাদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করেও বিজয় না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন আর অবৈধ মজুমদাকারি বিজ ব্যাবসায়ীরা দিনের পর দিন কৃষকদের কে একই বাণী শুনিয়ে যাচ্ছেন যে, বিজয় এসেছিল সব অন্য কৃষকরা নিয়ে গেছে আপনারা আগামীকাল আসুন।
তবে বিজ আলু কখন কিভাবে ব্যাবসায়ীদের কাছে পৌঁছে তা স্থানীয় কৃষকরা কেউ না জানলেও কালো বাজারে বিক্রির মাধ্যমে পকেট ভরছেন ব্যবসায়ীরা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের কেউ বা আলু বিজয় বিক্রি করছেন গভীর রাত থেকে ভোর ৪ টা পর্যন্ত। আবার কেউবা স্টোর থেকেই পার্শবর্তি বগুড়া, নওগাঁ, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জের কালোবাজারিদের কাছে অধিক লাভে বিক্রি করছেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদন জেলা হিসেবে পরিচিত জয়পুরহাটের মোট পাঁচটি উপজেলার মধ্যে কালাই ও ক্ষেতলাল উপজেলায় আলুর উৎপাদন হয় সর্বাধিক।
আর এদুটি উপজেলায় আলু বিজ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় ও জিম্মি হয়ে পরেছে আলু উৎপাদনকারী সাধারণ কৃষকরা।
আলু বিজের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে তিন থেকে চারগুন বেশি দামে কালোবাজার থেকে বিজ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারন কৃষকরা।
ক্ষেতলাল ও কালাই এলাকার বিভিন্ন স্থানে শতাধিক আলু উৎপাদনকারি কৃষকরা জানান, চলতি রোপা-আমন মৌসুমে তাদের উৎপাদিত ধান সমুদয় বিক্রি করেও শুধুমাত্র আলুর বিজয় ক্রয়ের টাকা হচ্ছেনা।
উপরন্তু আলু উৎপাদনে বিজ ছাড়াও সার, কীটনাশক, সেচসহ লেবার প্রয়োজন। ফলে এ দুটি উপজেলায় বিগত বছরগুলোতে সর্বত্র আলু উৎপাদন হলেও চলতি বছর বিজের কৃত্রিম সংকটের কারণে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক জমিতে চাষ সম্ভব হবে বলে আশংঙ্কা করা হচ্ছে।
এ দুটি উপজেলায় কৃষকদের সার্থে এখনো পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট প্রসাশনের কোন প্রকার হস্তক্ষেপ কিংবা তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বিক্ষুব্ধ কৃষকদের অভিযোগ আমাদের অসহায়ত্ব দেখার কেউ নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা যা চাইবে সেই মূল্যেই আমাদের বিজয় কিনতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রসাশনের গোপন যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।
গত ৬ নভেম্বর শুক্রবার সকালে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ক্ষেতলাল উপজেলার নিশ্চিতা বাজারে বিজ ডিলার আমিনুর হোসেন পলিন এর আনিকা বিজ ভান্ডার বিক্রয় কেন্দ্রে গিয়ে স্থানীয় অর্ধশতাধিক বিক্ষুব্ধ কৃষক কে দেখা গেলেও পলিন কে পাওয়া যায়নি। সেখানে পাওয়া যায় তার ভগ্নীপতি পরিচয় দানকারী এক মাষ্টার এবং তার বরো ভাই পরিচয় দানকারী ও যুবলীগ নেতা দাবিদার জনৈক পলাশ হোসেন কে।
ক্যামেরা বের করার সাথে সাথে তারা আগত কৃষকদের কে দ্রুত তাড়িয়ে দেন এবং ডিলার নেই আমরা এমনিতেই এখানে বসে আছি। এসময় তাদের বিক্রয় কেন্দ্রে ব্রাক সিড এর ৩০/৪০ বস্তা ডায়ামন্ড আলু বিজ এবং আমান এর ৩০/৪০ বস্তা বিজ দেখা যায়।
এসময় সাংবাদিকরা তাদের জনৈক কর্মচারির কাছ থেকে জানতে পারে ব্রাক সিডের ডায়ামন্ড আলু বিজের ৪০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ২৫ থেকে ২৮শত টাকায় এবং আমানের ৪০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ২৪ থেকে ২৭শত টাকায় বিক্রয় করা হচ্ছে।
নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে এতো বেশি মূল্য কেন নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তৎক্ষনাৎ জনৈক পলাশ হোসেন ঐ কর্মচারিকে চুপ থাকার নির্দেশ দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেন এবং তিনি সাংবাদিকদের কে বলেন আমরা কেবলমাত্র আমান বিজের ডিলার, ব্রাক সিডের কোন প্রকার বিজের ডিলার নয়।
ব্রাক সিডের এসব বিজ কে বা কাহারা এখানে এনে রেখেছে তা আমরা জানিনা। তিনি আরও বলেন ৪০ থেকে ৪৫ টন আমান বিজের জন্য আমরা বটতলী বাজারের ডিলার শাহাদুল ইসলাম কে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা অগ্রীম দিয়ে রেখেছি তারপরও তিনি আমাদের কে বিজ সরবরাহ না করে রাতের আধাঁরে উচ্চ মূল্যে বিভিন্ন কালোবাজারিদের নিকট বিক্রয় করে আসছেন।
এছাড়া তিনি ৬ অক্টোবর শুক্রবারই চলতি বছরে প্রথম ১০ টন আমান বিজ পেয়েছেন। সেই বিজেরও কেবলমাত্র ৩০/৪০ বস্তা দোকানে দেখা গেলেও অবশিষ্ট বিজ সকালেই এতো দ্রুত কোথাকার কৃষকদের কাছে বিক্রয় করেছেন তা তিনি জানাতে পারেননি। বরং তিনি যুবলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে দাপট দেখিয়ে সাংবাদিকদের প্রতি চড়াও হন।
এ সময়ে সাংবাদিকরা উক্ত বিক্রয় কেন্দ্রের প্রকৃত তথ্য জানতে বিজ ডিলার পলিন কে ফোন করলে তিনি বলেন, গত ১ নভেম্বর থেকে বিজ বিক্রি শুরু করেছি এবং গত ৩তারিখে ১৬ টণ আমান বিজ পেয়েছি। ব্রাক সিডের ডায়ামন্ড বিজের বিষয়ে পলিন জানান, তিনি এর সাব-ডিলার এবং এখন পর্যন্ত ১০টন বিজ পেয়েছেন
এদিকে গত ৫ নভেম্বর বৃহস্পতিবার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে আলু বিজ বিক্রয়ের অপরাধে জেলার আক্কেলপুর উপজেলায় ভ্রাম্মমান আদালত পরিচালনা করে দুইজন বিজ ব্যবসায়ীর অর্থদন্ড করা হলেও ক্ষেতলাল ও কালাই উপজেলায় এধরণের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
এ ব্যাপারে কালাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মোবারক হোসেন বলেন, কৃষকদের জন্য যা যা করণীয় কালাই উপজেলা প্রশাসন তার যথাযথ পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছেন।
যার মধ্যে উল্লেখ্য ভ্রাম্মমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে উচ্চ মূল্যে সার বিক্রির দায়ে চারজন ডিলারকে জরিমানা, ফাতেমা নামক ধানের বিজ দিয়ে কৃষকের সাথে প্রতারনার দায়ে ডিলারকে জরিমানা করা হয়েছে এবং ইতিমধ্যে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে আলোচনা করে উপজেলার সকল বিজ, সার কীটনাশক ডিলার দের নোটিশ করে মিটিং এর মাধ্যমে কৃষকদের সার্থ রক্ষার্থে কঠোর নির্দেশনা ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
ক্ষেতলাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ, এফ, এম, আবু সুফিয়ান বলেন এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।