বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আত্মস্বীকৃত খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আব্দুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার (১১ এপ্রিল) দিবাগত রাত ১২ টা ১ মিনিটে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জেলার মাহবুবুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এদিকে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ফটকে জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। একইসঙ্গে রয়েছেন কারারক্ষীরাও।
এর আগে রাত ১০টা ৫২ মিনিটে কারাগারে গিয়ে পৌঁছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তফা কামাল পাশা। এরও আগে রাত সোয়া ১০টার দিকে ঢাকার সিভিল সার্জন পৌঁছেন কারাগারে। এরপর ১০টা ৪৭ মিনিটে পৌঁছেন জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাসায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঘাতকরা। সেদিন ঘাতকদের নির্মম বুলেট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার সহধর্মিনী ফজিলাতুন নেসা, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সাব-ইন্সপেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক ও রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলের প্রাণ কেড়ে নেয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অন্য খুনিদের সঙ্গে ক্যাপ্টেন মাজেদ বঙ্গভবনে অবস্থান নেন। কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে মাজেদ তখন রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। এ সময় তিনি জেলখানায় জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডেও জড়িত ছিলেন। জাতীয় চারনেতাকে হত্যার দায়েও মাজেদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে দেশ ত্যাগের আগ পর্যন্ত অন্য খুনিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ পালন করে মাজেদ। পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তিনি ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই তারা সেসময় নিরাপদে দেশ ছেড়ে যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
মাজেদ সেসময় লিবিয়ায় তিন মাস ছিলেন। এরপর ‘পুরস্কার হিসেবে’ তাকেসহ অন্য অনেককে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়। মাজেদকে চাকরি দিয়ে পাঠানো হয় সেনেগালের বাংলাদেশ দূতাবাসে।
১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ আবদুল মাজেদকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশনে (বিআইডব্লিউটিসি) চাকরি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিব মর্যাদায় তিনি বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন। পরে তাকে তখনকার যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক করা হয়। এরপর দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব।
ইতিহাসের নৃশংসতম এ হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় আসা তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ জারি করে এর বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন। হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ‘ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ বাতিল করে হত্যাকাণ্ডটির বিচারের পথ সুগম করে। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রিসিপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ঢাকার ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ১০ (১০) ৯৬)।
সেসময় আটক হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে যান আবদুল মাজেদ। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, মাজেদ এ সময় থাইল্যান্ড, সেনেগাল, ভারত, পাকিস্তান, লিবিয়া ছাড়া জিম্বাবুয়েও কিছুদিন অবস্থান করেন। তবে দীর্ঘ সময় তিনি ভারতের কলকাতায় অবস্থান করেন বলে আইনশৃঙ্খলা জানিয়েছে।
আবদুল মাজেদ হলেন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় পলাতক ছয় খুনির মধ্যে একজন। পলাতক বাকি পাঁচজনের মধ্যে লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশিদ (বরখাস্ত) লিবিয়া ও বেলজিয়ামে অবস্থান করছেন। বেশিরভাগ সময় লিবিয়াতে থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম (বরখাস্ত) পাকিস্তানে অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।
লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী (বরখাস্ত) যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে, লে. কর্নেল (অব.) এন এইচ এমবি নূর চৌধুরী (বরখাস্ত) কানাডায় রয়েছেন। আর রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতের কারাগারে আটক বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিগত দুই দশক পা‌লি‌য়ে ভার‌ত গিয়েছি‌লেন আবদুল মাজেদ। গত মা‌র্চের মাঝামা‌ঝি‌ সময় তি‌নি ঢাকায় আসেন। পরে সোমবার (৬ এপ্রিল) রাত ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের সামনে থেকে মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৪৪ বছর ৭ মাস ২১ দিন পর গ্রেপ্তার হন তিনি। সবশেষ শুক্রবার স্ত্রীসহ পাঁচজন কারাগারে মাজেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফাঁসির আগে প্রত্যেক আসামিকে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়।
গত বুধবার ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এম হেলাল উদ্দিন চৌধুরী মাজেদের মৃত্যু পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। ওইদিন বিকেলে মাজেদ রাষ্ট্রপতির কাছে এ আবেদন করেন। কারা কর্তৃপক্ষ আবেদনটি বিকেলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে বঙ্গভবনে পৌঁছানো হয়। প্রাণভিক্ষার আবেদনটি বঙ্গভবনে পৌঁছার পরপরই তা খারিজ করে দেন রাষ্ট্রপতি। এটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় কারা কর্তৃপক্ষের সামনে দণ্ড কার্যকরে বাধা থাকছে না।
এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আবদুল মাজেদসহ ১২ আসামিকে ২০০৯ সালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ ও মুহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কার্যকর হয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title