গাজীপুর প্রতিনিধি: রাত পোহালেই বহুল প্রতীক্ষিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলবে। নগরীর ৪৮০টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টায় নির্বাচনি প্রচারণা শেষ হয়ে যায়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৃতীয় বারের নির্বাচনি তফশিল ঘোষণা, মনোনয়নপত্র জমা ও বাছাই, মনোনয়নপত্র বাতিল ও প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দ শেষে ৯ মে শুরু হয় মেয়র এবং ৫৭টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৯টি সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে নির্বাচনি প্রচারণা।
এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় মেয়র পদে কোনো প্রার্থী অংশগ্রহণ করেননি। তবে সাধারণ ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে বিএনপির অংশ নেওয়া এমন ২৯ জন প্রার্থীকে ইতিমধ্যে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় পুরো নির্বাচনে কিছুটা ভাটার টান দেখা গেলেও নগরীতে নির্বাচনি আমেজ, উত্সাহ-উদ্দীপনা কম ছিল না। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় চার-পাঁচটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনের নির্বাচনি প্রচারণায় বাধা, কর্মী-সমর্থকদের হুমকি এবং তার ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর করার বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ ছাড়া নির্বাচনি প্রচারণায় তেমন কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি।
ইতিমধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনের সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তা নির্বাচন উপলক্ষ্যে পৃথকভাবে গাজীপুরে এসে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। গাজীপুর মেট্রোপুলটন পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও রিটার্নিং কর্মকর্তাও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমতউল্লা খানও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন। সব মিলিয়ে গাজীপুর সিটির প্রায় ১২ লাখ ভোটারসহ চল্লিশ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যাশা করছেন একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যাতে সিটির কর্ণধার মেয়রসহ ৫৭ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও ১৯ জন মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন যাদের মাধ্যমে সিটির প্রত্যাশিত উন্নয়ন ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত হবে।
রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে ৪৮০টি ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য ৪৮০ জন প্রিজাইডিং অফিসার, ৩ হাজার ৪৯৭ জন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, ৬ হাজার ৯৯৪ জন পোলিং অফিসারসহ মোট ১০ হাজার ৯৭১ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে ৩৩৩টি প্রতিষ্ঠান। ভোটকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৩৫১টি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্র এবং ১২৯টি অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ সাধারণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গাজীপুর মহানগর পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম জনান, অতি গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভোটগ্রহণের সার্বিক প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রসমূহের নিরাপত্তা বিধানকল্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হবে। এ জন্য গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্রসমূহে অস্ত্রসহ এক জন এসআই অথবা এএসআই ও চার জন কনস্টেবল, অস্ত্রসহ এক জন অঙ্গীভূত আনসার পিসি, এক জন অস্ত্রসহ আনসার এপিসি, লাঠিসহ চার জন মহিলা ও ছয় জন পুরুষ আনসার/ভিডিপি সদস্যসহ মোট ১৭ জন মোতায়েন থাকবে। আর সাধারণ কেন্দ্রসমূহে অস্ত্রসহ এক জন এসআই অথবা এএসআই ও তিন জন কনস্টেবল, অস্ত্রসহ এক জন অঙ্গীভূত আনসার পিসি, এক জন অস্ত্রসহ এপিসি, লাঠিসহ চার জন মহিলা ও ৬ জন পুরুষ আনসার/ভিডিপি সদস্যসহ মোট ১৬ জন মোতায়েন থাকবে।
নির্বাচনি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মোবাইল টিম ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ, এপিবিএন, ব্যাটালিয়ন আনসার, বিজিবি ও র্যাব দায়িত্ব পালন করবে। এরমধ্যে প্রতিটি সাধারণ কেন্দ্রে একটি করে মোবাইল ফোর্স, প্রতি তিনটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন থাকবে। এছাড়া প্রতিটি থানা এলাকায় একটি করে মোট আটটি রিজার্ভ স্ট্রাইকিং ফোর্স মোতায়েন থাকবে। প্রতি দুটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি করে মোট ৩০টি র্যাবের টিম থাকবে। নগরীর পাঁচটি সাধারণ ওয়ার্ডে এক প্লাটুন করে মোট ১৩ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন থাকবে।
সাধারণ ছুটি :গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনি এলাকায় বৃহস্পতিবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। রবিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-৪ শাখার উপ-সচিব সোনিয়া হাসান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়। এদিন সব ব্যাংকও বন্ধ থাকবে।
এ সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩, তাদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৭ জন এবং মহিলা ভোটার ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৮ ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১৮ জন। নির্বাচনে মেয়র পদে আট, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৭৯ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৪৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মোট প্রার্থী ৩৩৩ জন। এবারেই প্রথম এ সিটিতে প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট হবে ইভিএমে।
প্রচার-প্রচারণা : সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এবার আট জন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মঙ্গলবার বিকালে প্রচারণার শেষ দিনে বৃষ্টি ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমতউল্লা খান টঙ্গীতে তার বাসভবনে ঘরোয়ভাবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। বিকালে টঙ্গী দলীয় কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ ও পথসভায় বক্তব্য রাখেন। এছাড়া নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নৌকার পক্ষে বিশাল বিশাল মিছিল বের করেন। এতে দলের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যোগ দেন। তিনি তার বাসভবনে নেতাকর্মীদের বলেন, সবাইকে সহাবস্থানে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করতে হবে। কোনো প্রকার সংঘাতে যাওয়া যাবে না। উত্সবমুখর পরিবেশে ভোট হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। চ্যালেঞ্জ থাকলেও নৌকার জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী তিনি।
দুপুরের পর স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়ে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছয়দানা, ভোগড়া বাইপাস মোড়, চান্দনা চৌরাস্তা, তেলীপাড়া, সালনাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রচার-প্রচারণা চালান। এ সময় তিনি বলেন, টেবিল ঘড়ি প্রতীকের পক্ষে যারা ভোট চাচ্ছেন তাদের আটকে হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি ভোটের নিরাপত্তা দাবি করেন।
জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন নেতাকর্মীদের নিয়ে নগরীর গাছা ও সদর মেট্রো থানা এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালান। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান নগরীর টঙ্গী পূর্ব, টঙ্গী পশ্চিম থানা, সদর মেট্রো, সালনা, বাসন, গাছা, কাশিমপুর ও কোনাবাড়ী এলাকায় গণসংযোগ করেন।
সরকার শাহনুর ইসলাম রনির ইশতেহার : মঙ্গলবার সকালে হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনুর ইসলাম টঙ্গীতে তার বাসভবনে ১৯ দফা নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি বলেন, পারিবারিক ঐহিত্য ও অভিজ্ঞতাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে কাজে লাগাতেই চাই।
নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণার শেষ দিনে সরকার শাহনুর ইসলাম রনি তার প্রচারে বাধা প্রদান করা হয়েছে বলে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন।