শেখ মুজিব ছিলেন সবার রাজনীতিবিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: আমাদের এ পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশে কয়েকটি নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একটি হলো ১৯৩৭ সালের নির্বাচন, যেখানে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টি একসঙ্গে ক্ষমতায় এসেছিল। এরপর ১৯৪৬-এর নির্বাচন, যেখানে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ বাংলায় জয়লাভ করে। এর মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে এগোল এ অঞ্চল। গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হলো ১৯৫৪ সালের নির্বাচন। এর মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হলো যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন, মানুষ কোনোভাবেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর অংশ নয়। আরেকটি নির্বাচন হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। আইয়ুব খানের নির্বাচন। সরাসরি ভোট নয়, মৌলিক গণতন্ত্রীদের বা রাজনৈতিক মধ্যস্বত্বভোগী দিয়ে নির্বাচন। লক্ষণীয় যে পূর্ব পাকিস্তানের যারা মৌলিক গণতন্ত্রী ছিল তাদের প্রায় অর্ধেক আইয়ুব খানকে ভোট দেয়নি। সুতরাং প্রতিটি নির্বাচনেই নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। তবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে যে ইতিহাসের ধারাবাহিকতার এটিই চরম পর্যায়। রাষ্ট্র গঠনের পর্যায়। স্বাধিকার চেতনার দিক থেকে এটি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আরেকটি দিক হলো সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ। এটিই প্রথম নির্বাচন, যেখানে সবাই ভোট দিয়েছিল। ইংরেজিতে যাকে বলে ইউনিভার্সাল অ্যাডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ। অর্থাৎ সবার অংশগ্রহণ ছিল। সবাই স্বাধীন দেশ চাইলে বলে ভোট দেয়নি। মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় না কখন স্বাধীন দেশ হবে, ইতিহাস সিদ্ধান্ত নেয়। মানুষ কেবল সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে। এটিই ছিল সত্তরের নির্বাচনের মূল নির্যাস।

সংকটটা তাহলে কি ছিল যে কারণে আমরা এ নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি? এর কারণ হলো পাকিস্তান আদৌ কোনো রাষ্ট্র ছিল না। পাকিস্তান ছিল ‘ফলস স্টেট’। অর্থাৎ এটি রাষ্ট্র নয়, এটিকে জোর করে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র বানানো হয়। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। অথচ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, এটা হবে এক পাকিস্তান। এটা নিয়ে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রতিবাদ করেন। দলিল খুলে দেখা যায়, দুটো রাষ্ট্রের কথা বলা আছে। পরে সংশোধন করে সেটিকে উপস্থাপন করা হয়। তাতে স্বাধীন কেন্দ্রীয় এক রাষ্ট্রের কথা বলা হয়। রাজনীতিবিদরা যে এটা মেনে নেননি। তারা এর পর পরই যুক্ত বাংলা আন্দোলন শুরু করেছিলেন।

বাংলার রাজনীতিবিদরা কখনো পাকিস্তান মেনে নেননি। তারা সবসময় ভাবতেন, একটা স্বাধীন দেশ হবে। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরীর কথায়ও তার সত্যতা মেলে। তার সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা ভাবতাম একটা স্বাধীন হবে এবং এর নেতা একজন মানুষই কেবল হতে পারেন; তার ভাষায় ‘দ্য টল ম্যান ফ্রম গোপালগঞ্জ।’ অতএব তরুণদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ভাবমূর্তি ছিল তা অবিসংবাদিত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান হলো, ১৯৪৯ সালের মাথায় সেই দল আওয়ামী মুসলিম লীগ হয়ে গেল। এর মানে কেন্দ্রীয় দল হিসেবে দলটির কোনো গুরুত্ব ছিল না। এটা সবসময় ছিল বাংলার দল। এটা ছিল পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দল। এ দলই রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

এমন নয়, কারো হঠাৎ করে মাথায় এল আওয়ামী লীগ করবে। মওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ করতেন, শেখ মুজিবও মুসলিম লীগ করতেন এবং সোহরাওয়ার্দীও মুসলিম লীগ করতেন। তাদের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী ছিলেন পাকিস্তানপন্থী। কিন্তু ভাসানী ও শেখ মুজিব পাকিস্তানপন্থী ছিলেন না। তারা সবসময় নিজস্ব স্বাধীন দেশ পূর্ববঙ্গের রাজনীতি করে গেছেন। একই সঙ্গে ভারতবর্ষে যে ওপরতলার রাজনীতি ছিল তারা তারও বিরোধী রাজনীতি করতেন।

এ ধারাবাহিকতায় ’৫৪-এর নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবাই একসঙ্গে হলো। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, তারা পাকিস্তানকে বাতিল করে দিচ্ছে। অবশ্য পাকিস্তান সরকার কয়েক মাসের মাথায় যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিল। যুক্তি দেখিয়েছিল, বাঙালি-অবাঙালির মধ্যে দাঙ্গা হয়েছে। আরেকটি যুক্তি ছিল, যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক স্বাধীন দেশের কথা বলেছেন। এ পর্যায়ে আমাদের মনে রাখা দরকার, স্বাধীন দেশের ভাবনাটা আমাদের ইতিহাসের অংশ ১৯৪৭-এর আগে থেকেই। মোয়াজ্জেম চৌধুরীর অধীনে একটি গোপন সংগঠন সৃষ্টি হয়, নাম ইনার গ্রুপ। তারা পাকিস্তান হওয়ার মিটিং করে স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। ১৯৫৪ সালে এ যুক্তি দেখিয়ে তারা যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়। তার মানে তারা জানত এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা চাইবে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা। তারা জানত পাকিস্তান আদৌ কোনো রাষ্ট্র নয়। যে রাষ্ট্র আদৌ কোনো রাষ্ট্র নয়, সেটিকে জোর করে কতদিন টিকিয়ে রাখা যায়?

’৫৪ সংকটের পর আবার সংকট বাড়ল এবং ’৫৭ সালে গিয়ে, সেটি ফের প্রকট আকার ধারণ করল। যদিও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান। কিন্তু পরিষ্কার ছিল যে সংকট আরো বাড়ছে। এর একটা চূড়ান্ত স্ফূরণ ঘটল সত্তরের নির্বাচনে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পরিষ্কার হলো, আওয়ামী লীগেরই আন্দোলনের ম্যান্ডেটটা আছে। বলে রাখা ভালো, আওয়ামী লীগ বলতে কেবল দল বোঝায় না। আওয়ামী লীগ বলতে বাংলাদেশের রাজনীতির আকাঙ্ক্ষার যে মূল ধারাটি আছে, সেটিকে বোঝায়। আওয়ামী লীগের মধ্যে চরম ডান থেকে চরম বাম সবই ছিল। সিরাজুল আলম খানদের অংশ দেখলে দেখা যাবে চরম বাম, খন্দকার মুশতাকদের অংশ দেখলে দেখা যাবে চরম ডান। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের মূল ধারাটাই বাংলাদেশ এবং সে কারণেই ১৯৭০-এর নির্বাচনের সাফল্য।

সুতরাং সত্তরের নির্বাচন আলাদাভাবে না দেখে আমরা যদি ধারাবাহিকতায় দেখি তাহলে পরিষ্কার হবে, কেন এ বিজয়টা অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং এত বড় ভূমিকা রেখেছিল। এটা প্রথমবার হয় ১৯৩৭ সালে, ১৯৪৬ সালে হয়েছে, ১৯৫৪ সালে হয়েছে ও ১৯৭০ সালে হয়েছে। চারবার ভোট দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে যে তারা আলাদা রাষ্ট্র। এটা আকস্মিক ঘটনা নয়, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। বলা চলে, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার শেষ অংক।

উল্লেখ করা দরকার, আমাদের প্রচেষ্টা কেবলই স্বাধীনতার নয়, রাষ্ট্র গঠনেরও প্রচেষ্টা। ১৯৪০ সাল থেকে আমাদের এ প্রচেষ্টা। এ রাজনীতিতেই আসলে শেখ মুজিব ছিলেন। তার রাজনীতি বুঝতে হলে গোপালগঞ্জের রাজনীতি বুঝতে হবে। তিনি সবসময় সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করা ক্ষমতাবান ও অবস্থাসম্পন্নদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তার সংগ্রাম আজীবন এমনই ছিল। অন্যদের সঙ্গে নিয়ে তিনি সবসময়ই এটা করেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতি হলো অ্যালায়েন্সের রাজনীতি। মোর্চা গঠনের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধু যে শ্রেণী থেকে এসেছেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, কৃষক শ্রেণী ও প্রান্তিক শ্রেণী থেকে এসেছেন তারাই মোর্চা গঠন করেছেন সবসময়। এটি হলো আওয়ামী লীগের পূর্ববঙ্গের রাজনীতি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবে ছিল সবার দল। কাজেই সাফল্য অবধারিত।

শেখ মুজিব ছিলেন সবার রাজনীতিবিদ। তাকে নিয়ে কোথাও কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। ১৯৬৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ওপর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রভাব ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার প্রভাব শেষ হয়ে যায়। শেখ মুজিব একবারও আপস করেনি। এ হিম্মত তারই ছিল। তার কাছে পরিষ্কার ছিল যে এটিকে স্বাধীন দেশ করতে হবে। দেশভাগের পরও বঙ্গবন্ধুকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, পাকিস্তান রাষ্ট্র হচ্ছে। আপনি কী মনে করেন? তিনি বলেছিলেন, এ রাষ্ট্রে পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি কলোনি। এই যে কলোনিমুক্ত করার আন্দোলন যে মানুষ করে, তার তো কোনো সুযোগ নেই বিশ্বাসঘাতকতা করার। এটিই মৌলিকভাবে বুঝতে হবে।

বঙ্গবন্ধু সংগঠনকে সফল করেছেন, শক্তিশালী করেছেন। এ সংগঠনের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারেনি। এটাই প্রমাণ করে যে সাংগঠনিক শক্তিই প্রধান। যে সংগঠন শক্তিশালী তাকেই তো মানুষ ভোট দেবে। খুচরো পার্টিকে মানুষ ভোট দেয় না। শেখ মুজিব আন্দোলন, ভাবনা ও সংগঠন তিনটাকে একত্র করতে পেরেছিলেন। এ কারণে তার পক্ষে বিজয় লাভ সম্ভব হয়েছিল—দলের জন্য, তার জন্য এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য।

শেখ মুজিব বুঝতে পেরেছিলেন, ইতিহাস কী এবং এর শক্তি কোথায়। বাংলাদেশের কৃষক সমাজ, প্রান্তিক সমাজ যদি না দাঁড়াত, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা থেকে শুরু করে শরণার্থীদের আশ্রয় দান সবকিছু কেন তারা করল? এ শক্তিটা কোত্থেকে এল। কেউ কি ঘোষণা দিয়েছে তোমাদের এটা-ওটা করতে হবে, মুজিবনগর সরকারের রেডিও শুনে করেছে। এটা তো মনের ভেতর থেকে এসেছে। এটিই আমার মনে হয় ইতিহাসের শক্তি। ইতিহাসের শক্তি হচ্ছে যে আমরা আলাদা রাষ্ট্র। আমরা আলাদা রাষ্ট্রের নাগরিক। এ আলাদা রাষ্ট্রের ইতিহাস শুরু হয়েছে অনেক আগে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৯৪০-এর দশকে শুরু হয়েছে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে।

বঙ্গবন্ধু ১৯৬২-এর পর থেকে প্রক্রিয়ার ওপর অনেক নির্ভর করতেন। ধীরে ধীরে এগোনোর কৌশল নিয়েছেন। চেয়েছিলেন প্রক্রিয়ারই বিজয় হোক। শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন পরিকল্পনা করেছেন স্বাধীন দেশ হবে। ধারাবাহিকভাবে এগিয়েছেন। তিনি কখনো গাদ্দারি করেননি। সাধারণ মানুষ চায় এমন এক রাষ্ট্র হোক, যেখানে তাদের কল্যাণ হবে। অতএব, বঙ্গবন্ধু জনরাজনীতি করবেন। এর বাইরে যাবেন না, এটিই প্রমাণ হয়েছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title