ঘাটতি নিয়ে কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকার দ্বিতীয় ডোজের প্রয়োগ শুরু

0

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ থেকে দেশে শুরু হচ্ছে কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকার দ্বিতীয় ডোজ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে নয় লাখ ডোজ টিকার ঘাটতি নিয়েই শুরু করা হচ্ছে দ্বিতীয় ডোজের গণটিকা দান কর্মসূচি। বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকলেও সরকার বলছে, টিকা কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থাতেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক টিকা পেয়ে যাবে বাংলাদেশ।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে গণটিকা দান কর্মসূচি শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৫৫ লাখের বেশি মানুষের শরীরে টিকার প্রথম ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রথম ডোজ নেয়া এসব মানুষই আজ থেকে পাবেন দ্বিতীয় ডোজের টিকা। একই সঙ্গে নতুন করে প্রথম ডোজের প্রয়োগও চলবে। গত রোববার অনুষ্ঠিত কভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড ডিপ্লয়মেন্ট কোর কমিটির সভায় দ্বিতীয় ডোজের পাশাপাশি প্রথম ডোজ প্রয়োগ চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কোর কমিটির সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে টিকাদান কার্যক্রম-সংক্রান্ত নির্দেশনা বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে দেয়া হয়।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের আবিষ্কৃত টিকা উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ব্রিটিশ-সুইডিশ মালিকানাধীন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকা। স্থানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ টিকা উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে রফতানি করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট। বাংলাদেশের জন্য তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে গত বছরের নভেম্বরে সেরামের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করে বেক্সিমকো ফার্মা ও সরকার। টিকার দামও আগাম পরিশোধ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার।

চুক্তির শর্ত অনুসারে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশে আসার কথা। গত জানুয়ারিতে ৫০ লাখ ডোজ টিকা এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসেছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। মার্চে কোনো টিকা আসেনি। এর মধ্যে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় টিকা রফতানিতে স্থগিতাদেশ জারি করে ভারত সরকার। এতে আগামী কয়েক মাস টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। তবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৩২ লাখ ডোজ টিকা উপহার দিয়েছে ভারত।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ৫৫ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৩ জন নারী-পুরুষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের দেয়া বিনা মূল্যে টিকা নিয়েছেন। সে হিসেবে ১ কোটি ২ লাখ টিকার মধ্যে ৪৬ লাখ ৩১ হাজারের কিছু বেশি টিকা অবশিষ্ট রয়েছে। অর্থাৎ নতুন করে প্রথম ডোজের প্রয়োগ শুরু ছাড়াও দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের ক্ষেত্রেই ৯ লাখ ৩৭ হাজারের কিছু বেশি টিকার ঘাটতি রয়েছে।

টিকার পর্যাপ্ততা নিশ্চিত না করেই কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া ছাড়া কোনো পথ নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা বলছেন, বর্তমানে যে সংখ্যক টিকা বাংলাদেশের হাতে আছে, তা প্রয়োগ চলাকালেই বাকি টিকা হাতে এসে যাবে। তাছাড়া মজুদ থাকা টিকা আগামী দুই মাসের মধ্যে প্রয়োগ শেষ করতে না পারলে অনেকাংশের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। টিকার জোগানের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নেতৃত্বে গঠিত বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্স ছাড়া অন্য কোনো উৎস আপাতত নেই। কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে বাংলাদেশের ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা পাওয়ার কথা। তবে টিকার সংকটের কারণে এ টিকার বিতরণও বিলম্বিত হতে পারে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, ভারতের টিকা রফতানিতে নিষেধাজ্ঞাই এ বিলম্বের কারণ।

জনস্বাস্থ্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার জন্য শুধু একটি উেসর ওপর নির্ভর করা ঠিক হচ্ছে না। এ মুহূর্তে বিভিন্ন উেসর সঙ্গে যোগাযোগ করে টিকা আনা উচিত। জনসন অ্যান্ড জনসন, রাশিয়ার স্পুটনিক-৫ ও চীনের টিকা সহজে সংরক্ষণ ও পরিবহনযোগ্য। এ টিকা পাওয়ার জন্য সরকারের জোর চেষ্টা চালানো উচিত।

টিকার সংকট সাড়ে নয় লাখ নাকি আরো অনেক বেশি, তা এ মুহূর্তে বলা যাবে না বলে মন্তব্য করছেন বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, টিকার সংকট অনেক বেশি হতে পারে। মানুষ এখন টিকার বিষয়ে আরো আগ্রহী হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের সময় প্রথম ডোজের জন্য বেশি মানুষ আগ্রহী হতে পারে। এতে সংকট সাড়ে নয় লাখে সীমাবদ্ধ থাকবে না। হাতে থাকা টিকা অল্পদিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

টিকা সংকট হলে পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হবে উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার বলছে এপ্রিলে টিকার একটি চালান আসবে। সেটা এলে ভালো। নাহলে টিকা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া কঠিন হবে। এ টিকা বিরতি দিয়ে দিলে কোনো কাজে আসবে না। পরিকল্পনামাফিক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচিত সবাইকে দেয়া গেলে করোনার সংক্রমণ কমানো যাবে। একই সঙ্গে যেসব মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তাদেরও শনাক্ত করা উচিত। সেক্ষেত্রে টিকার ওপর চাপ কিছুটা কমবে।

টিকা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া এখন কঠিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এখন প্রথম ডোজের প্রয়োগ বন্ধ করে দেয়া উচিত। প্ল্যান বি ধরে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আর সেটি হলো যারা প্রথম ডোজ নিয়েছেন, কেবল তাদের দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া। এতে করে সম্মুখসারি এবং কো-মরবিটির ব্যক্তিদের দ্বিতীয় ডোজের আওতায় আনা যাবে। দ্বিতীয় ডোজের জন্য যে প্রায় সাড়ে নয় লাখ ডোজের ঘাটতি রয়েছে, তা সংগ্রহ করা বাংলাদেশের জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়। এরপর স্বাভাবিক টিকা কার্যক্রম চালাতে জোরালোভাবে টিকার সন্ধান করা।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায়নি ধরে নিয়েই কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হবে। যে টিকা আছে তা শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। এর মধ্যে ভারতের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে প্রায় এক কোটির কাছাকাছি টিকা সেরাম আমাদের দিতে পারবে। এছাড়া কোভ্যাক্স থেকে টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে।

তবে যদি এ দুটি উৎস থেকে টিকা পাওয়া না যায়, তাহলে কী পরিকল্পনা রয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। টিকার সংকট এখন বিশ্বজুড়ে। সে কারণেই দেরি হচ্ছে। তবে সময়মতো টিকা পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title