পলাশ ফুটেছে, শিমুল ফুটেছে, এসেছে দারুন মাস, ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সেজেছে অনবদ্য সাজে। আর শিমুল আর কৃষ্ণচূড়ার কচি সবুজ পাতা, বাহারি ফুলেরা বসন্তের রঙে রাঙিন করে তুলেছে প্রকৃতি। প্রকৃতির অপরূপ সাজের সেই রঙে কোকিলও মাতিয়ে তুলেছে কুহু… কুহু….. সুরবীণায়। ১৪ ফেব্রæয়ারি ছিল পহেলা ফাল্গুন। জীবনে আর একটি বসন্তের আগমন। চির সবুজ বাংলার প্রকৃতিতে এসেছে ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম মাস। ‘আহা, আজি এ বসন্তে/ কত ফুল ফোটে/ কত বাঁশি বাজে/ কত পাখি গায়…।’
আর বসন্তকে বরণ করতে বগুড়া শহরে বসন্ত উৎসব পালন করেছে হাজারো তরুণ-তরুণী। এছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মীদের নানা অয়োজনে শহর ছিল মুখরিত। বসন্ত উৎসব ও বিশ্বভালোবাসা দিবসের সাজসজ্জায় মেতে উঠেছিল বগুড়া শহর। হলুদ শাড়ি, চুড়ির সঙ্গে খোঁপায় তরুণীরা পরে নানা রঙের ফুল। বিভিন্ন স্থানে দল বেধে মেতেছে আড্ডায়।
বগুড়ার ফুল মার্কেটে গিয়ে চোখে পড়ে শত শত তরুণ-তরুণীদের সরব পদচারণা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে স্মরণীয়-বরণীয় করে রাখতে জোড়া-জোড়া প্রেমিক যুগলে ভরে গেছে বগুড়ার ফুল মার্কেট।
করোনার মহামারী উপেক্ষিত করে তাই বসন্ত বরণের উৎসব ছিল দালানের খোলস ছেড়েছে বাসন্তী সাজে জড়ো হন বগুড়া শহর ও বিভিন্ন উপজেলাবাসী। সুরের সম্মোহনে ফাল্গুনের প্রথম প্রহরে মিলে মিশে একাকার প্রকৃতি আর মানুষের মুখরতা। বাংলা প্রকৃতি এখন স্নিগ্ধময়ী-বাসন্তী। শীতের জরাগ্রস্থতা কাটিয়ে নতুন পাতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠছে রিক্ত বৃক্ষরাজিও। বসস্তকে ঘিরে বাংলার জনপদে উৎসবের জোয়ার বয়ে যায়। লোক-কারুশিল্প পণ্য ছাড়াও এসব মেলায় বাহারি পসরা বসে জেলা ও উপজেলা সদরে শহরগুলোতে।
১৪ ফেব্রæয়ারি রবিবার পহেলা ফাগুন ছিল বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস। এ দুটি উৎসব একই দিনে হওয়ায় ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় বেশি। উৎসব দুটি ঘিরে ফুলের দোকানে বেড়েছে ফুলের সরবরাহ। ফুলের বাড়তি চাহিদা মেটাতে নিজেদের প্রস্তুত রেখেছিল বগুড়া সদরসহ বিভিন্ন উপজেলা শহরের ফুলের দোকানিরা। প্রতিটি দোকানে থরে থরে বাহারি ফুলের পসরা সাজিয়েছিলেন তারা। বসন্ত উৎসব ও ভালবাসা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিককর্মীরা তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে নৃত্য ও সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ নানা উদ্যোগ।
ঋতুরাজ বসন্ত বরণে কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া নাট্য সংগঠন কলেজ থিয়েটার বগুড়া শহরের সাতমাথায় মুজিব মঞ্চে ১৪ ফেব্রæয়ারি রবিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় বসন্তবরণে পদযাত্রা, বসন্ত কথামালা, বসন্তের গান, কবিতা ও নৃত্যানুষ্ঠান, রাতে শততম ফিউশন বাউল মঞ্চায়ন করে।
কলেজ থিয়েটারের আহŸায়ক রবিউল করিম ও সদস্য সচিব আব্দুল ওয়াদুদ জানান, বসন্ত উৎসবে তৌফিক হাসান ময়নার নতুন নাটক আছার উদ্দীন ছাফাতুল্লা ফকিরের জবানবন্দি মঞ্চায়ন হয়।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সরকারি শাহ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. শহিদুল আলম। প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না। বিশেষ অতিথি ছিলেন জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ খান রনি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ সিদ্দিকী, বগুড়া ইয়ুথ কয়্যারের সভাপতি আতিকুর রহমান মিঠু। বসন্ত উৎসব পালন করে সংশপ্তক থিয়েটার ও থিয়েটার আইডিয়া যৌথভাবে। বগুড়া শহরের রোমেনা আফাজ মুক্ত মঞ্চে, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেরা দম্পতি নির্বাচন ও ফানুস উড়ানোর মাধ্যমে বসন্ত উৎসব পালন করে।
বসন্ত উৎসব, ভালবাসা দিবস উপলক্ষে ফুল ব্যবসায়ীদের কথায় জানা গেছে, এবারের বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে অন্তত ২০/২৫ লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে বলে তারা জানান। মূলত: মহামারী করোনার প্রভাবে অনেক দিন যাবৎ স্থবির হয়েছিল ফুলের বাজার সহ সমগ্র ফুল মার্কেট। করোনার প্রভাব স্থিমিত হয়ে পড়ায় ব্যবসায়ীদের মাঝে ভালো ব্যবসা হওয়ার আশা জেগে উঠেছে। একাধিক ফুল ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, সারা বছরে ৪টি বড় উৎসব যথা- ১৪ই ফেব্রুয়ারী ১লা ফাল্গুন বসন্ত উৎসব ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ শে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ২৬ শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ, ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। এসব উৎসবকে কেন্দ্র করে সারাদেশের ন্যায় বগুড়াতেও ফুল চাষী ও ফুল ব্যবসায়ীরা গত বছরে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে।
১৪ ফেব্রæয়ারি রবিবার বিকালে সরেজমিনে দেখা গেছে বগুড়া শহরের শহীদ খোকন পার্ক সংলগ্ন ফুলের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় বেড়েছে প্রচুর । তবে বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে বগুড়া শহরের ১৮টি ফুলের দোকান রয়েছে। এলাকার প্রতিটি ফুলের দোকান বেশ সরগরম। জেলা সদরের পাশাপাশি শেরপুর, দুপচাচিয়া, আদমদিঘী উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলার শহরের ব্যস্ত সময় পার করছে মৌসুমি ও স্থায়ী ফুল ব্যবসায়ীরা। অন্যদিনের তুলনায় ফুলের দাম দুইগুণ-তিনগুণ বেশি দাম হাঁকা হলেও ক্রেতারা খুব একটা আপত্তি করছে না। পছন্দমত ফুল কিনেই ফিরছে সবাই। তবে ফুল ক্রেতাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশি।
এবারের বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বসন্ত উৎসবকে বরণ করতে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী যুগলরা ফুল মার্কেটে গিয়ে রজণীগন্ধা, গোলাপ সহ রকমারী ফুল কিনেছে ইচ্ছামতো।
এবার দেশি প্রতিটি লাল গোলাপ বিক্রি হয়েছে ২০ থেকে ৪০ টাকা, বিদেশি লাল গোলাপ, সাদা, গোলাপী গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। রজনীগন্ধার প্রতি স্টিক ১৫ থেকে ২০ টাকা, একগুচ্ছ সাদা চন্দ্রমল্লিকা ৫০ থেকে ৭০ টাকা, গøাডিওলাস প্রতি পিস ১০ থেকে ২০ টাকা, জারবেরা প্রতিটি ২০ থেকে ২৫ টাকা, জিপসি ফুল-২০ টাকা, হাইব্রিড ১৫ টাকা, গাদাফুল ১০০টি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া মেয়ের ক্রাউন (মাথার রিং) ৮০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে প্রতিপিস। সব ধরনের
সবচেয়ে বেশি পছন্দ খোঁপায় দেয়া গাধা ফুল। এবার গাধা ফুল বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা শ’ হিসেবে। তবে ফুলের ঝুড়ি ও মুকুটের দামও কয়েকগুণ বেড়েছে।
এদিকে চুলের খোঁপায় গাধা ফুল না দিলে বসন্ত উৎসবই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে এক প্রেমিক যুগল এমনটাই বলেছেন । শুধু তাই নয়, সুদূর সারিয়াকান্দি উপজেলা থেকে আসা এক প্রেমিক যুগল নাম প্রকাশ না করা না শর্তে জানিয়েছে, রাতে বগুড়ায় থাকব, আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সারাদিন মনের আনন্দে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবে এমনটিই তাদের পরিকল্পনা।
ফুল কিনতে এসে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সুমাইয়া পারভীন ও ইসরাত খাতুন বলেন, ‘খুব ইচ্ছা ছিল ফুল দিয়ে খুব বড় করে খোঁপা করবো। ফুলের যা দাম! ইচ্ছা থাকলেও কিনতে সাহস পাচ্ছি না। বিশেষ দিন আসলেই ব্যবসায়ীরা কোনও না বাহানা দিয়ে ফুলের দাম বাড়িয়ে দেয়।’
স্ত্রীর জন্য লাল গোলাপের গুচ্ছ কিনতে আসা নাজমুল হুদা নয়ন বলেন, ‘একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম তাকে। কিন্তু ফুলের যে দাম! এখন কি করবো চিন্তায় আছি। ফুল তো দিতেই হবে। ফুল ছাড়া ভালোবাসার দিনটা মলিন হয়ে যাবে। সেই সুযোগে ব্যবসায়ীরা এমনিতেই দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
বগুড়া ফুল মার্কেটের পুরাতন ব্যবসায়ী আপন ফুল ঘরের স্বত্বাধিকারী মোকলেছার রহমান বাটুল জানান, গত বছর ব্যবসা হয়নি। তবে এ বছর ভালো ব্যবসা হয়েছে। যে কারণে আমরা উজ্জীবিত।
তবে তিনি এও আশংকা প্রকাশ করেন যে, চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। উৎসব আয়োজনও হচ্ছে চুপিসারে সীমিত পরিসরে। যে কারণে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। তার পরও তিনি আশাবাদী এই ভেবে যে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে যে হারে ফুল কেনা-বেচা হয়েছে আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও তা আরো বেগবান হবে।
এ ব্যাপারে বগুড়া জেলা ফুল ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ জুয়েল হাসান জানান, গত বছরের মার্চ মাস থেকে করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা ব্যবসায়িক ভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। অনেক ফুল ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়ে ইতিমধ্যে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। কিন্তু পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন বছরের শুরুতে তারা বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে নতুন করে ব্যবসা শুরু করেছে। আর সে কারণেই বগুড়ার শহর থেকে শুরু করে প্রতিটি উপজেলায় ফুল চাষীরা নব উদ্দোমে নার্সারী গুলোয় ফুল চাষ শুরু করেছে। আর ব্যবসায়ীরা নিজেদের বিগত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার বগুড়া ফুল মার্কেটের প্রতিটি দোকানে ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকার ফুল বিক্রির জন্য মজুত করেছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন বসন্ত উৎসব ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে যে পরিমাণ ফুল বিক্রি হয়েছে তা যদি আগামী দিনের অন্যান্য জাতীয় দিবসগুলোতে অব্যাহত থাকে তবে ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
এ ব্যাপারে ফুল ব্যবসায়ীদের ফুলের বাড়তি দামের বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর ফুল ঘরের মালিক উত্তম দাস, মুন্না ফুল ঘরের মালিক রেজাউল হক মুন্না বলেন, ‘ভালোবাসা দিবস ও বসন্ত উৎসব’এবার একসাথে হওয়ায় এবং মাতৃভাষা দিবস এক সপ্তাহ পরেই ফুলের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। তার সাথে কারোনাভাইরাসের জন্য চীন থেকে ফুল তেমন আসছে না। সেক্ষেত্রে দেশীয় ফুলের উৎপাদন স্থল যশোরের পাশাপাশি সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর থেকে ফুল আমদানি করা হয়ে থাকে। তাই দেশিয় ফুল চাষীরা দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় বাধ্য হয়ে আমাদেরও বাড়তি দামে ফুল বিক্রি করতে হচ্ছে।
এ ছাড়া ‘বসন্ত ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ থেকে ৩ লাখ গোলাপের চাহিদা আছে। কিন্তু দেশে এত গোলাপ উৎপাদন হয় না। বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আনতে হয়। তাই গোলাপের দাম অনেক বেশি পড়ে। আমাদেরকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়।’ অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ফুলের বাজারও জমজমাট হতে পারে বলে আশাবাদী ফুল ব্যবসায়ীরা।
দীপক কুমার সরকার
বগুড়া প্রতিনিধি