নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকার ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে বলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন। প্রথম দিকে এই ব্যবস্থা ঐচ্ছিক হবে। মানে যাঁর ইচ্ছা তিনি এই পেনশন স্কিমে যুক্ত হবেন।
গতকাল বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে ভার্চুয়াল মাধ্যমে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান অর্থমন্ত্রী। শুরুতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মীরা এই কর্মসূচির বাইরে থাকবেন। কারণ তাঁরা এরই মধ্যে পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর নির্দেশনা দেন। ওই দিন গণভবনে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার’ কৌশলপত্র উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় আট কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ১৪ লাখের বেশি। তাঁদের বাদ দিলে আগামী এক বছরে সরকার প্রায় আট কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে চাচ্ছে।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, পেনশনব্যবস্থা সম্পর্কে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, বার্ধক্যজনিত কারণে যাঁরা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাঁদের এই সুবিধা দেওয়া হবে। এই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য পাওয়া রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। বার্ধক্যজনিত কারণে অভাবে পড়েছেন, এমন নাগরিকরা পেনশন পাবেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এখন এটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। পেনশনব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে দেশের প্রত্যেক মানুষ লাভবান হবে। ’
মুস্তফা কামাল বলেন, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। ২০৫০ সালে সেটি ৮০ বছর হবে। ২০৭৫ সালের প্রাক্কলনে গড় আয়ু হবে ৮৫ বছর। ফলে আগামী তিন দশকে মানুষ অবসর গ্রহণের পর আরো ২০ বছর বেঁচে থাকবে। কিন্তু সব নাগরিক পেনশন হিসাব খুলতে পারবে। প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতি ঐচ্ছিক থাকবে, পরে বাধ্যতামূলক করা হবে। ’
যেভাবে দেওয়া হবে পেনশন : অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট থাকবে। কেউ চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। মাসিক সর্বনিম্ন জমার অর্থ নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা দিতে পারবেন। অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হলে হিসাব সাময়িক বন্ধ থাকবে। পরে জরিমানাসহ বকেয়া দিয়ে হিসাব চালু করতে পারবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে নাগরিকরা পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবেন।
৬০ বছর পূর্তিতে নাগরিকরা নির্ধারিত হারে পেনশন পাবেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁরা পেনশন সুবিধা পাবেন। ৭৫ বছর বয়সের আগে কেউ মারা গেলে নমিনি পেনশন সুবিধা পাবেন। সে ক্ষেত্রে নমিনি ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। তবে জমাকারীর অবর্তমানে এককালীন টাকা তোলার সুযোগ থাকবে না।
খসড়া অনুযায়ী, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পেনশনের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। এ জন্য সুদ গুনতে হবে। কেউ ১০ বছর অর্থ জমা দেওয়ার পর মারা গেলে টাকা পাবেন তাঁর নমিনি। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। প্রণয়ন করা হবে পৃথক আইন।
খসড়ায় আরো বলা হয়, পেনশনের জন্য নির্ধারিত জমা দেওয়া অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। অর্থাৎ কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তাঁর অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে।
খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের জমা দেওয়া অর্থ নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে।
মাসে কত টাকা পেনশন পাওয়া যাবে : অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমানভিত্তিক একটি হিসাব দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা জমা দিলে ১০ শতাংশ মুনাফা এবং আনুতোষিক ৮ শতাংশ হিসাব ধরে ৬০ বছর বয়সের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন।
কেউ ৩০ বছর বয়সে অর্থ জমা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। তবে চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও বেশি হবে।