নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী : রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর একজন। তার নাম সুলতানা আহমেদ সাগরিকা। গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ১৯,২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত জোন-৭ এর কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পাঁচজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।
নির্বাচনে আনারস প্রতীকে সাগরিকা পেয়েছেন ৬ হাজার ২৬৩ ভোট। এই আসনের বর্তমান নারী কাউন্সিলর উম্মে সালমা মোবাইল ফোন প্রতীকে ৩ হাজার ২৩১ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। আর হেলিকপ্টার প্রতীকে ৫ হাজার ৪৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন নাজমা খাতুন নামে এক নারী। এ ছাড়া নূরজাহান পারভীন বই প্রতীকে ৩ হাজার ১২৬ ভোট, বীনা মজুমদার জিপগাড়ি প্রতীকে ২ হাজার ২৯২ ভোট এবং মোসা. সুমি চশমা প্রতীকে ৭০৫ ভোট পেয়েছেন।
গত ২ জুন প্রতীক বরাদ্দের দিনে সাগরিকা আহমেদ আনারস প্রতীকই চেয়েছিলেন। কিন্তু আরেক প্রার্থীও চান এই প্রতীক। শেষে লটারি হয়। এতে তিনি আনারস প্রতীকই পান। প্রতীক পেয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘লটারির মাধ্যমে আমি আনার প্রতীক জয় করেছি। এটা আমার নির্বাচনে প্রাথমিক জয়। ভোটেও আমি জয়ী হবো। সাগরিকার এ কথায় সত্য হয়েছে।
নির্বাচিত হওয়ার পর আজ বৃহস্পতিবার সকালে সাগরিকা বলেন, ‘আমি ভোটারদের একটা ইশতেহার দিয়েছি। পাঁচ বছরে আমি এই ইশতেহার বাস্তবায়ন করব। জনগণ আমাকে সম্মান দিয়েছে, আমিও তাদের সম্মান দেব।’
ভোটের প্রচার চলাকালে সাগরিকা অভিযোগ করছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তার নামে অপপ্রচার করছেন। তারা বলছেন, সাগরিকা নির্বাচিত হলে এলাকায় তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ‘অত্যাচার’ বেড়ে যাবে। নির্বাচিত হওয়ার পর সাগরিকা বললেন, ‘এটা যে অপপ্রচার ছিল তা ভোটারেরা বুঝতে পেরেছেন। ভোটারেরা ভেবেছেন, আমি নির্বাচিত হলে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ‘অত্যাচার’ বাড়বে না। আমি চাইব না যে, আমার এলাকার মানুষ খারাপ থাকুক।’
তিনি বলেন, ‘অপপ্রচার করে যে লাভ হয় না তা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা শিক্ষা নিতে পারেন। সবার মনে রাখা উচিত, এটা জনগণের সিদ্ধান্ত। আমি এক ভিন্নধর্মী মানুষ। ভোটারেরা ভাবলেন, সবাইকেই তো সুযোগ দিয়েছেন। এবার আমাকে দিয়ে দেখা যাক। এটাই।’
সাগরিকার বাড়ি নগরীর শাহমখদুম থানার শিল্পীপাড়া এলাকায়। মা-বাবার চার সন্তানের একজন তিনি। বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে মা-বোনের সঙ্গে থাকেন সাগরিকা। সংসারের দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই। সাগরিকার পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। নবম শ্রেণিতে ওঠার পর সহপাঠীদের টিপ্পনীর কারণে স্কুল ছাড়তে হয় তাকে। এক সময় বাড়িও ছাড়তে হয়েছিল তাকে।
তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে কাজ করেন সাগরিকা। তিনি ‘দিনের আলো হিজড়া সংঘ’ নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। ২০০০ সাল থেকে সংগঠনটি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভোটে দাঁড়িয়ে সাগরিকা বলছিলেন, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য কথা বলার কেউ নেই। সরকারের কাছে তাদের ব্যাপারে ভুল বার্তা যায়। এ জন্য তিনি নারী কাউন্সিলর হতে চান। তাহলে নিজেদের কথা বলতে পারবেন। এই জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করতে পারবেন। অবশেষে বিপুল ভোটেই নির্বাচিত হলেন সংগ্রামী মানুষ সুলতানা আহমেদ সাগরিকা।
এই নির্বাচনে সিটি করপোরেশনের ১০টি সংরক্ষিত জোনের মধ্যে ছয়টিতেই এসেছে নতুন মুখ। আর জোন-১ এর তাহেরা খাতুন, জোন-৫ এর সামসুন নাহার, জোন-৮ এর নাদিরা বেগম ও জোন ১০ এর সুলতানা রাজিয়া এবারও নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি ছয় জোনের মধ্যে জোন-২ এর আয়েশা খাতুনকে হারিয়ে মোসা. শিউলী, জোন-৩ এর মুসলিমা বেগম বেলীকে হারিয়ে সেবুন নেসা, জোন-৪ এর শিরিন আরা খাতুনকে হারিয়ে আলফাতুন নেছা, জোন-৬ এর মাজেদা বেগমকে হারিয়ে মমতাজ মহল, জোন-৮ এর উম্মে সালমাকে হারিয়ে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্য সুলতানা আহমেদ সাগরিকা এবং জোন-৯ এর আয়েশা খাতুনকে হারিয়ে মোসা. ফেরদৌসি নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন।