নিজস্ব প্রতিবেদক: বৈশ্বিক মহামারী থেকে মুক্তি কামনায় দেশজুড়ে বর্ণিল আয়োজনে উদ্যাপিত হলো খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ‘বড়দিন’। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বের কোটি কোটি খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বাঙালীরাও যিশুখ্রিস্টের আদর্শ ও শিক্ষায় শান্তির পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে মহা আড়ম্বরে পালন করেন দিনটি। রাজধানীসহ দেশের সব গির্জায় আয়োজন করা হয় বিশেষ প্রার্থনার। সাজানো হয় লাল-নীল-সবুজ রঙের উজ্জ্বল আলোতে। কেক কেটে যিশুখ্রিস্টের জন্মবার্ষিকীও পালন করেন অনেকে। খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি এসব আয়োজনে অংশ নেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। করোনা মহামারী শেষে সুন্দর জীবনের প্রার্থনায় নিজেকে সমর্পণ করেন তারা।
শনিবার সকালে রাজধানীর কাকরাইলের সেন্ট ম্যারিস ক্যাথিড্রাল চার্চ, তেজগাঁওয়ের পবিত্র জপমালা রানীর গির্জা, মোহাম্মদপুরের সেন্ট ক্রিস্টিনা চার্চ, পুরান ঢাকার সেন্ট থমাস চার্চ, হলিক্রস গির্জা, আরমানিটোলার আর্মেনিয়ান গির্জাগুলো ঘুরে দেখা যায় গির্জাগুলোর ভেতরে ও বাইরে নানা রঙের বেলুন, নক্সা করা ককশিট, রঙিন কাগজ, জরি ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। তবে এসব গির্জায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল কৃত্রিম ‘ক্রিসমাস ট্রি’। গির্জা প্রাঙ্গণে থাকা এসব গাছে ঝোলানো হয়েছিল রং-বেরঙের বাতি। প্রায় সব গির্জায় আলোকসজ্জার পাশাপাশি যিশুখ্রিস্ট মা মেরি ক্রিসমাস ট্রিসহ বিভিন্ন মূর্তি দিয়ে বানানো হয়েছে গোশালা। ছিল সান্তাক্লজের সাজে পুতুলও। যেগুলো ছিল শিশুদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কোথাও কোথাও আবার জীবন্ত সান্তাক্লজও দেখা গেছে। লাল-সাদা পোশাক আর লম্বা সাদা দাঁড়িতে সান্তা সেজে শিশুদের মধ্যে উপহার বিলিয়েছেন অনেকেই।
মূলত একদিন আগেই শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় এসব গির্জায়। তেজগাঁও গির্জায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রার্থনার আয়োজন করা হয় দুদিনই। প্রথম দিন শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১০টায় এবং বড়দিনের দিন অর্থাৎ শনিবার সকাল ৭টা ও ৯টায় একই ভাবে প্রার্থনার আয়োজন করা হয় কাকরাইলের সেন্ট ম্যারিস ক্যাথিড্রাল চার্চেও। শনিবার সকাল ৮ থেকে ৯টা পর্যন্ত এখানে পরিচালিত হয় বিশেষ প্রার্থনার মোহাম্মদপুর গির্জায়ও শুক্রবার রাতের পাশাপাশি শনিবার সকালে হয় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান।
তবে করোনাভাইরাস সতর্কতায় অন্যবারের চাইতে কিছুটা সীমিত আয়োজন ছিল গির্জাগুলোতে। মাস্ক পরা ছিল বাধ্যতামূলক। প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই গির্জাগুলোর ভেতরে ও বাইরে ছিল প্রচুর লোকসমাগম। তেজগাঁওয়ের গির্জার গেটের সামনে বসে বাহারি পণ্যের মেলা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মনোহারি বিক্রেতারা নিজেদের পণ্য নিয়ে রাস্তার ফুটপাথে পসরা সাজিয়ে বসেন। রাজধানীর মিরপুর থেকে তেজগাঁও সান্তাক্লজবেশী গির্জায় আসা লিরা বলেন, সারাবছর পরিবারের সবাই অপেক্ষা করে থাকি দিনটি উদ্যাপনের জন্য। আগে থেকেই এ বছর সান্তাক্লজ সাজবো বলে পরিকল্পনা করেছিলাম। এতদিন পছন্দের কেনাকাটা শেষে আজ সান্তা সাজতে পেরে খুব ভাল লাগছে। উচ্ছ্বসিত কাকরাইল গির্জায় আসা মুসলমান ধর্মাবলম্বী রুমানাও। তিনি বলেন, ধর্ম যার যার। উৎসব সবার। এই মর্মেই পরিবার থেকে শিক্ষা পেয়েছি। আর তাই বড়দিনের আনন্দ উপভোগ করতে বন্ধুদের নিয়ে গির্জা এসেছি।
বড়দিন উদ্যাপনের বিষয়ে তেজগাঁও পবিত্র জপমালা রানীর গির্জার পালক পুরোহিত ফাদার সুব্রত বনিফাস গোমেজ বলেন, পাপ স্বীকার সংস্কারের মাধ্যমে খ্রীস্টানরা বড়দিনের আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি নেয়। আমরা যেসব অন্যায়-অপরাধ করি, সেগুলো যাজকের কাছে গিয়ে স্বীকার করি এবং ঈশ্বরের ক্ষমা লাভ করি।
এদিকে বাংলাদেশের ক্যাথলিক খ্রীস্টানদের ধর্মগুরু আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ ওএমআই বড়দিন উপলক্ষে সবাইকে ভ্রাতৃত্ব, একতা ও সম্প্রীতি স্থাপনের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা যাতে ধর্মের উর্ধে গিয়ে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করি। কারণ, পৃথিবীতে পরিবার একটাই, সেটা মানবপরিবার। একটি পরিবার গড়ে তুললে এ পৃথিবী অনেক সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ হবে। যিশুখ্রিস্ট একে অপরকে ভালবাসা ও ক্ষমার শিক্ষা দিয়েছেন।
বড়দিনকে ঘিরে সাজানো হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেলগুলোও। রঙিন আলোকসজ্জায় ‘ক্রিসমাস ট্রি’ সাজানোর পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে রং-বেরঙের আলোকসজ্জা।
দিবসটি উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তৎপর ভূমিকা ছিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি)। গির্জায় নিরাপত্তা জোরদারসহ গির্জা এলাকায় অনস্পট ও সোশ্যাল মিডিয়া প্যাট্রলিং বৃদ্ধি করা হয়। নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গির্জাগুলোর আশপাশে নিয়োজিত ছিল সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশও। এছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি নজরদারিতে নিয়োজিত ছিল পুলিশের বিশেষ টিম।