বছর ব্যবধানে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২-৩ গুণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাজারে কোনোভাবেই পণ্যের দামে লাগাম টানা যাচ্ছে না। হু হু করে বেড়েই চলছে। চাল থেকে শুরু করে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, আদা-রসুন, চিনি বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে। এমনকি মাছ ও গরুর মাংসের দাম ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। শুধু তাই নয়, দাম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শাক-সবজিতেও হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন-মূল্য স্বাভাবিক করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা কাজে আসছে না। বরং অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বছরের ব্যবধানে প্রায় সব পণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর অসাধু ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’ সক্রিয় থাকলেও কার্যকর অর্থে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রতিবছরই ক্রেতাকে জিম্মি করে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম দাম বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্রটি।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয় মেলাতে রীতিমতো দম বন্ধের উপক্রম হচ্ছে ক্রেতা সাধারণের। বিশেষ করে হিমশিম খাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ।

এদিকে গত বছরের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে পণ্য পরিবহণ, গণপরিবহণের ভাড়া এবং সব ধরনের সেবার দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। এছাড়া ৩ মাসের ব্যবধানে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ৫ শতাংশ করে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দুই দফায় বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ। এরমধ্যে গত এক বছরে নিত্য ব্যবহার্য্য পণ্যসহ সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের সেবার দাম লাগামহীন ভাবে বেড়েছে।

এতে সাধারণ মানুষের জীবন চালানো আরও দায় হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক পরিবার তাদের চাহিদায় কাটছাঁট করছে। এতে পুষ্টিতে টান পড়ছে। আবার অনেকেই আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের খরচ মেটাচ্ছেন। আবার অনেকেই ধার-দেনা করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে সব ধরনের সেবার দাম বাড়লেও বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজি বন্ধ হলে অন্তত নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ‘হাঁসফাঁস’ অবস্থার সৃষ্টি হতো না সাধারণ ক্রেতাদের।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, বছরের ব্যবধানে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চিনি ৫৮ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০ টাকা, দেশি মুরগি ২০০, গরুর মাংস ১০০, রুই মাছ ১০০, খোলা আটা ১০, দেশি পেঁয়াজ ২০, আলু ১০, দেশি রসুন ১৪০, আমদানি করা রসুন ৯০, শুকনা মরিচ ১২০, হলুদ ৪০, দেশি আদা ২৬০, আমদানি করা আদা ১১০ ও মোটা চাল ২ টাকা ও প্রতি হালি (৪ পিস) ডিম ৮ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছর প্রতিটি পণ্যের দাম অসহনীয়ভাবে বাড়ছে। কিন্তু সেভাবে ক্রেতার আয় বাড়ছে না। আয় না বাড়ায় ক্রেতার বাড়তি দরে পণ্য কেনা এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্রেতা অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্যকিছু কেনা বাদ দিয়েছেন। অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে শরীরে পুষ্টি ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে।

তিনি আরও জানান, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাজারে নজর না থাকায় পণ্যের দাম বাড়তি রেখে অসাধুরা ভোক্তার পকেট কাটছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। তাই অসাধুরা বারবার ক্রেতাকে জিম্মি করে অতি মুনাফা করছে।

রাজধানীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা, যা গত বছর একই সময় ছিল ৫০ টাকা। খোলা আটা কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৪২ টাকা। আলুর কেজি ৪০, যা গত বছর ছিল ৩০ টাকা। দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬৫ টাকা, যা আগে ৪৫ টাকা ছিল। দেশি আদার কেজি ৪০০, যা গত বছর একই সময় ছিল ১৪০ টাকা। দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা, যা আগে ৮০ টাকা ছিল। শুকনা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা। যা আগে ৩৩০ টাকা ছিল।

প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৮০ থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ১৮৫ টাকা, যা আগে ছিল ১৬৫ টাকা। কেজিতে ২০০ টাকা দাম বেড়ে দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা। প্রতি কেজি রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা, যা আগে ৩৫০ টাকা ছিল। পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা কেজি। যা গত বছর একই সময় ১৭০ টাকা ছিল। গত বছর প্রতি কেজি চিনি ৮২ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এছাড়া বছরের ব্যবধানে ৩৬ টাকা কেজি খাবারের প্যাকেটজাত লবণ ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা, যা গত বছর একই সময় ৪২ টাকা ছিল। সবজির মধ্যে প্রতি কেজি বরবটি বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা, যা আগে ৬০ টাকা ছিল। কচুর লতি বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা। যা আগে ৬০-৭০ টাকা ছিল। ঢেঁড়স বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা কেজি। যা গত বছর বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা।

মিল্কভিটার তরল দুধ আগে ছিল ৮০ টাকা লিটার। এখন তা বেড়ে ৯০ টাকা হয়েছে। প্রতি কেজি গুঁড়া দুধের মধ্যে ডানো বিক্রি হচ্ছে ৮৪০ টাকা। যা আগে ৭০০ টাকা ছিল। পাশাপাশি সব ধরনের শিল্পপণ্যের দামও বেড়েছে। বিস্কুটের প্যাকেট আগে যেগুলো ১০ টাকা ছিল, তা এখন ১৫ টাকা। ৬৮ টাকা দামের চানাচুরের প্যাকেট এখন ৮০ টাকা। ৩০ টাকা দামের সাবান ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর মালিবাগ কাঁচাবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। নিত্যপণ্যের যেভাবে দাম বাড়ছে আর যে টাকা আয় করছি, তা দিয়ে এখন আমি সব খরচ বহন করতে পারছি না। বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় খাবার রান্না ছাড়া কোনো ধরনের ভালো-মন্দ খাবার জুটছে না। পরিস্থিতি এমন-জীবনযাপন করতেই এখন খুব কষ্ট হচ্ছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে প্রতিদিন বাজার তদারকি চলছে। অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় এনে অসাধুদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। বরং সামনে তদারকি ব্যবস্থা নতুন ভাবে আরও ঢেলে সাজিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title