দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: দু’চোখে স্বপ্ন ছিল পাকাবাড়িতে বসবাস, আর একটু নিজনামে জায়গা বা সম্পত্তির। অনেকটা অবাস্তব ছিল অসহায় জীবনে। পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতে হতো অন্যের আশ্রয়ে বা পথ-ঘাটের ধারে। সেসব ভূমিহীন অসহায় মানুষগুলো এখন তাদের হৃদয়ের গভীরে লুকানো স্বপ্ন বর্তমানে বাস্তবে পরিণত হওয়ায় চোখেমুখে ও হৃদয়ে আনন্দধারা বিরাজ করছে। খুঁজে পেয়েছেন তাদের কাঙ্খিত স্বপ্নের ঠিকানা, ফেলছে শান্তির নিঃশ্বাস। খুশিতে আত্মহারা হয়ে কেঁদে ফেললেন ঘর ও জায়গা প্রাপ্ত অনেক ভূমিহীন পরিবাররা।
শেরপুরের ভূমিহীন ও গৃহহীন অসহায় খায়রুজ্জামান, নজরুল ইসলাম, আজেনা খাতুন, আরজিনা খাতুন, হামিদা বেগম, রোকেয়া খাতুন, জোসনা, আয়ন বিবি, হায়দার আলী, রবি কর্মকার আনন্দে আত্মহারা হয়ে জানান, সন্তান-স্বামী নিয়ে একটি ঝুঁপড়ি ঘরে অন্যের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে থেকে কোনো রকমে দিনাতিপাত করে আসছি। দিনমজুরি করে যেখানে নুন আনতে পানতা ফুরায়, সেখানে পাকাঘর তৈরি করা স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের মতো একজন গরিবদের খবর নিয়ে ঘর তৈরি করে দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়ায় এটা আমার জীবনে সেরা উপহার পেলাম। স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি পাঁকা বাড়িতে ঘুমাতে পারবো। তবে এই ঘরে নামাজ পড়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করব, তিনি যেন অনন্তকাল বেঁচে থাকেন, আর এভাবে আমাদেরমতো গরীব ও অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারেন বলে আবেগে আপ্লুতভাবে ভূমিহীন পরিবারের সদস্যরা জানান।
২৩ জানুয়ারি শনিবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প এর অধীনে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলার ভূমিহীনদের জমি ও গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রম। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সারাদেশে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বাড়িগুলো হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর ধারাবাহিকতায় আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলা এবং ৫০টি ব্যারাকসহ মোট এক হাজার ৭০২টি গৃহ প্রদান করা হবে। এদের মধ্যে সদরে ২৫০টি, শাজাহানপুরে ১৫টি, শেরপুরে ১৬৩টি, ধুনটে ১০১টি, সারিয়াকান্দিতে ১০৭টি, সোনাতলায় ১২৫টি, গাবতলীতে ৪৫টি, শিবগঞ্জে ১৮০টি, আদমদীঘিতে ১০০টি, দুপচাঁচিয়ায় ১৩৩টি, কাহালুতে ৭৭টি এবং নন্দীগ্রামে ১৫৬টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও সারিয়াকান্দি উপজেলার কর্ণিবাড়ী ইউনিয়নের শনপঁচা মোল্লাপাড়ায় ১০টি ব্যারাকে ৫০, নান্দিনার চরে ১৬টি ব্যারাকে ৮০, চন্দনবাইশা ইউনিয়নের বানিয়াপাড়ায় ২৪টি ব্যারাকে ১২০টি পরিবারকে গৃহ প্রদান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর গৃহদান কার্যক্রম উপলক্ষে জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলায় সকাল ১১টার দিকে গৃহ হস্তান্তর কার্যক্রম জেলা প্রশাসক জিয়াউল হক, জেলা পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঞা বিপিএম বার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মুনজিল আলী সরকার, পৌর মেয়র মতিউর রহমান মতি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাসেল মিয়া, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মমতাজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
একই দিনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই বাড়িগুলো হস্তান্তর কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় বগুড়ার শেরপুর উপজেলা হলরুমে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), মো আব্দুল মালেক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো লিয়াকত আলী সেখ, শেরপুর পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো আব্দুস সাত্তার, সহকারী কমিশনার (ভূমি), উপজেলা পরিষদের ভাইস-চেয়ারম্যানদ্বয়, আশ্রয়ণ বিষয়ক জেলা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্যবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তাগণ, ইউপি চেয়ারম্যানগণ, বীরমুক্তিযোদ্ধাগণ, সাংবাদিকগণ, উপকারভোগীগণ। এরআগে শেরপুর উপজেলায় গৃহ নির্মাণ কার্যক্রমের উপর ভিডিও ক্লিপ্স এবং আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ কার্যালয় থেকে প্রেরিত ভিডিও ক্লিপ্স প্রদর্শন করা হয়।
এদিন বগুড়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান সফিকের সভাপতিত্বে ও উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুর রহমানের পরিচালনায় হস্তান্তরকালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু, জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালাহ্উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সাংসদ খাদিজা খাতুন শেফালী, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাহার আলী মন্ডল, জেলা পরিষদের সদস্য মাফুজুল ইসলাম রাজ, মাহফুজা খানম লিপি, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এইচ এম ইকবাল, ডালিয়া নাসরিন রিক্তাসহ আরও অনেকে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন ঘোষণার পরপরই বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আগত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের হাতে ২ শতক জমিসহ ঘরের কবুলিয়ত দলিল, নামজারি খতিয়ান, রেকর্ড সংশোধনী ফি জমা দানের ডিসিআর, সার্টিফিকেট, দাখিলা ইত্যাদি তুলে দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মুজিব শতবর্ষ পালন করছে সরকার। বছরটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভূমি ও গৃহহীন আট লাখ ৮২ হাজার ৩৩টি পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়ার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আজ উদ্বোধনের পর পর্যায়ক্রমে এ তালিকার সবাই এই সুবিধা পাবে।
উপকারভোগীদের মধ্যে যাদের জমি আছে, তারা শুধু ঘর পাবে। যাদের জমি নেই, তারা ২ শতাংশ জমি পাবে (বন্দোবস্ত)। দুই কক্ষবিশিষ্ট প্রতিটি ঘর তৈরিতে খরচ হচ্ছে এক লাখ ৭১ হাজার টাকা। সরকারের নির্ধারিত একই নকশায় হচ্ছে এসব ঘর। রান্নাঘর, সংযুক্ত টয়লেট থাকছে। টিউবওয়েল ও বিদ্যুৎ সংযোগও দেওয়া হচ্ছে।
তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে এই ঘরগুলো দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ৪১৯ কোটি ৬০ লাখ টাকায় তৈরি করা হয়েছে ২৪ হাজার ৫৩৮টি বাড়ি। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ সহনশীল বাড়ি নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৬৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকায় ৩৮ হাজার ৫৮৬টি বাড়ি এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের আওতায় ৫২ কোটি ৪১ লাখ টাকায় ৩ হাজার ৬৫টি বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। প্রকল্পগুলোতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দেশের ৪৯২টি উপজেলার প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে পাকা ঘরসহ বাড়ি হস্তান্তর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর আওতায় প্রায় ৯ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। এ মাসে ৭০ হাজারের পাশাপাশি আগামী মাসে আরও ১ লাখ পরিবার বাড়ি পাবে।