দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: তরমুজ একটি রসালো ফল যা খেলে শরীরের ক্লান্তি দূর করে। ভ্যাপসা গরমে শরীর থেকে ঝড়ে পড়া ঘামের কারনে সৃষ্টি হওয়া শারীরিক পানি শূন্যতা রোধ করতে এমনিতেই তরমুজের জুড়ি নেই, তার ওপর নতুন জাতের তরমুজ দেখে সাধারণ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। তরমুজের গায়ের রং হলুদ(গোল্ডেন ক্রাউন) ও কালো জাতের হলেও ভেতরে একদম অন্যসব তরমুজের মতোই লাল এবং সুমিষ্টিয় তুলনামূলক বেশি। প্রতিদিনই শত শত লোকজন দেখতে আসছেন এবং তরমুজ ক্রয় করার আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
তাইওয়ানের সোনালী রঙয়ের এই তরমুজ বগুড়ার শেরপুর ও শাজাহানপুর উপজেলায় চাষ হয়েছে। গ্রামে গ্রামে ফসলের মাঠে দেখা দিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্য।
তরমুজের ভালো চাহিদা থাকায় দেশব্যাপী যখন দক্ষিণ অ লের মৌসুমী ফল তরমুজ বেচা-বিক্রি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তুঙ্গে। সেই কথা চিন্তা করে রসালো ফল ‘হলুদ জাতের’ ও ‘কালো জাতের’ তরমুজ চাষ করে এলাকায় কৃষকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন শেরপুর উপজেলার কৃষিপ্রেমী শিক্ষক আব্দুস সালাম। তিনি করোনাকালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় ইউটিউব দেখে মাচায় তরমুজ চাষ পদ্ধতি শিখেছেন বলে দাবী করেন। অন্যদিকে কৃষি অফিসের নির্দেশনায় আধুনিক প্রযুক্তিতে এ দুটো জাতের তরমুজ উৎপাদন করেছেন শাহজাহানপুর উপজেলার বামুনিয়া গ্রামের কৃষক মোকছেদ, মিজানুর রহমান সহ কয়েকজন।
সরেজমিনে দেখাগেছে, উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের বড়াইদহ গ্রামের শিক্ষক সালাম ৮৬শতক জমিতে উন্নত জাতের তৃপ্তি, ব্লাক বেবি ও ব্লাক সুইট জাতের তরমুজ চাষ করেন। তিনি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে। তরমুজ গুলো পলি মাটিতে লাগানোর পর গাছ গুলোতে ফল আসার আগ মূহুর্তে বাঁশের মাচায় উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে মাচায় হলুদ ও গাঢ় সবুজ তরমুজ ঝুলছে। হলুদ রংয়ের তৃপ্তি জাতের তরমুজ, গাঢ় সবুজ ব্লাক বেবি ও ব্লাক সুইট এসব উন্নত জাতের তরমুজ গুলো মাঁচার নিচে ঝুলছে। অপরদিকে শাহজাহানপুর উপজেলা বামুনিয়া চাঁদবাড়িয়া এলাকাসহ উপজেলায় প্রায় ২০ বিঘা জমিতে এ বছর বিদেশি জাতের তরমুজ গোল্ডেন ক্রাউন, মধুমিতা (হলুদ) ও ব্লাক কিং চাষ করা হয়েছে।
এ জাতের তরমুজ চাষ পদ্ধতি শুধু শেরপুরের শিক্ষক আব্দুস সালাম ও শাহজাহানপুরের কয়েকজন কৃষকই রপ্ত করেনি, এখন অনেকেই এ পদ্ধতিতে তরমুজ চাষে আগ্রহী হচ্ছে। আগামী বছরে এ ফল চাষের ব্যাপকতা বাড়বে বলে এমনটাই আশাবাদী হয়েছেন দুই উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারা।
এ জাতের তরমুজ চাষ পদ্ধতি নিয়ে শিক্ষক আব্দুস সালাম জানান, শুরু থেকে জমিতে জৈবসার অন্যান্য সার প্রয়োগের পর বেড তৈরি করে পুরো বেড পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়ে গাছ রোপণ করেছেন। বর্তমানে এই ফল গুলির বয়স এখন ৫০ দিন। এরই মধ্যে ফল গুলোতে নেটিং ব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ফল গুলি ৬০ দিনের মাথায় প্রায় ৩/৪ কেজি ওজন হলে পরিপক্ক হবে এবং তা বাজারজাত করার উপযোগী হবে।
তবে শিক্ষক আব্দুস সালাম আরো জানান, শুধু তরমুজই নয়। তার জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফল মালটা, পেয়ারা, ভিয়েতনাম নারিকেল চাষ করেছেন। তবে নতুন জাতের এই তরমুজ মাচায় চাষ করতে পেরে তিনি খুশী ও সফল। গত বছর করোনা কালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় ইউটিউব দেখে মাচায় তরমুজ চাষ করেছেন। অধিক ফল আসলেও বাজারজাত করার মাঝামাঝিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে লোকশান গুনতে হয়েছে। এ বছর ৮৬ শতক জমিতে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা খরচ করেছেন। তবে এই তরমুজগুলো ৪৫ থেকে ৫৫টাকা কেজি দরে বাজার মূল্য হলে প্রায় ৪ লক্ষ টাকার তরমুজ বিক্রয় করবেন বলে তিনি আশাবাদী।
বামুনিয়া চাঁদবাড়িয়া এলাকায় কৃষক মোকছেদ আলী ও মিজানুর রহমান জানান, গণমাধ্যমে সংবাদে আকৃষ্ট হয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগের পরামর্শে ২০ শতক জমিতে প্রথমবারের মতো সৌখিনে তরমুজ আবাদ শুরু করছি। গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে তিনি বীজ বপন করেন। এরপর সঠিক সময়ে সার ব্যবস্থাপনা, মাচা তৈরি, ডগাকর্তন, ডগা মাচায় উঠিয়ে দেওয়া ও তরমুজের গায়ে জাল পরিয়ে টানিয়ে দেওয়াসহ যাবতীয় কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে সম্পন্ন করেন। বীজ বপনের ৭৫ দিনের মাথায় খামারে ঝুলতে থাকে সোনালী রঙের গোল্ডেন ক্রাউন তরমুজ। একই সময়ের মধ্যে ধরেছে ব্লাক বস তরমুজও। একই কথা বলেন উপজেলার পালাহার দক্ষিণপাড়া গ্রামে রুহুল আমিন (৪০) এবং সালেহ আহমেদ (২৭) নামে দুই যুবক এই তরমুজ চাষ করে সফলতা পায়। তবে নতুন জাতের চাষকৃত এসব তরমুজ ও ফলন দেখতে প্রতিদিন লোকজন ভিড় করছে। দর্শনার্থীরা জেনে ও শিখে নিচ্ছেন এ জাতের তরমুজ চাষের পদ্ধতি।
বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম জানান, গোল্ডেন ক্রাউন এবং ব্লাক বস ভ্যারাইটির তরমুজ অত্যন্ত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন একটি সুস্বাদু ফল। সাধারণত উঁচু জমি এবং দো-আঁশ মাটি এই তরমুজ চাষের জন্য উপযুক্ত। আমাদের দেশে দক্ষিণা লে এই তরমুজের চাষ শুরু হয়েছে। বীজ বপনের ৪০ দিনের মাথায় ফুল আসে। আর ফুল থেকে পরিপুষ্ট তরমুজ হতে সময় লাগে ৩০-৩৫ দিন। গাছের গোড়ায় পানি জমলে গাছে পচন ধরতে পারে এমন শঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি একটু উঁচু জমিতে তরমুজ চাষের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন চাষিদের। ব্লাক কিং ও গোল্ডেন (সোনালী) তরমজু নতুন জাতের বলে কিছু কিছু চাষ হয়েছে। বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হলে এই তরমুজের ব্যাপকতাও বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে শেরপুর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা রাজিয়া সুলতানা বলেন, উপজেলায় এবার নতুন ফসল হিসেবে ২ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। কিন্তু হলুদ(সোনালী) জাতের তরমুজ এই প্রথম চাষ শুরু করেন আব্দুস সালাম। তবে আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগীতা করছি এবং কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। আশা করছি আগামী বছর এই জাতের তরমুজ চাষ আরো বাড়বে এবং কৃষকরা অধিক লাভবান হবেন।
উপজেলা দুটোতে এ ধরণের তরমুজ চাষ অনেকটা নতুন হওয়ায় জমিগুলোতে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীরা ভিড় করছেন। সাধারণ তরমুজের চেয়ে জাত দুটোতে অধিক সুমিষ্টিয় হওয়ায় ও ব্যাপক চাহিদা থাকায় এলাকার কৃষকদের মধ্যে এ নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখা দিয়েছে।