দীপক সরকার, বগুড়া প্রতিনিধি: বেশ কয়েকদিন ধরে উত্তরের হিমেল হাওয়ায় শীত জেঁকে বসেছে। আর একারণেই বগুড়ার সান্তাহারের চাঁদর কম্বল পল্লী বলে খ্যাত গ্রাম শাওইল গ্রার্মে কর্ম ব্যস্ততাও বেড়েছে কারিগরদের। পরিবারের ছোটবড় সবাই মিলে এখন তাঁতে ব্যস্ত চাঁদর-কম্বল তৈরীতে। তবে উৎপাদন খরচ বাড়লেও তাদের তৈরি চাঁদর কম্বলের দাম বাড়েনি। এদিকে তাঁত পল্লীকে ঘিরে গড়ে ওঠা হাতে বোনা কম্বলের প্রসিদ্ধ দেশের বৃহৎ হাট ‘শাঁওলের হাট’ জমে উঠেছে। প্রতিদিন গোটা দেশ থেকে পাইকারি ক্রেতারা আসছে ।
বগুড়া শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সান্তাহার-বগুড়া সড়কের মুরইল থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে এই হাট ও কম্বল গ্রাম শাওইল। এ গ্রামে তাঁতের খট খট মুখরিত শব্দে আর সুতার বুননে মিশে আছে তাদের জীবন যাত্রার অকল্পনীয় স্বপ্ন। শাওইল সহ আশে পাশের গ্রামের মানুষরা আঁকড়ে ধরে আছে আদি শিল্প। নারী-পুরুষ সহ নানা পেশার মানুষের কর্ম ব্যস্ততা। কেউ সুতা ছাড়াচ্ছে আবার কেউ বা চরকা নিয়ে বসে সুতা নলি বা সূচিতে ওঠাচ্ছে কেউ বা সুতা ববিন করছে। কোনটা চাকাওয়ালা আবার একেবারেই বাঁশ কাঠ দিয়ে হাতের তৈরী তাঁতও রয়েছে। বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়েটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরি হয় কম্বল, চাঁদর, মাফলার, বেডকভার সহ আনুষাঙ্গিক পন্য। তাঁতিরা সুতা বোনা সহ গায়ের চাদর, কম্বল, বিছানার চাদর, লেডিস চাদর, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালা সহ নানা ধরনের শীত বস্ত্র তৈরী করে। জেলার আদমদীঘি ও দুপচাঁচিয়া উপজেলার অর্ধশত গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা কম্বল পল্লীতে বছর জুড়েই এসব বস্ত্র তৈরি হলেও শীতকালে চাহিদা বেড়ে যায়। সরকারিভাবে শীতকালে বিতরণকৃত কম্বলের সিংহভাগই উৎপাদন হয় শাওইল গ্রামে। তবে এ শাওইল গ্রামের হাটে দোকান রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় ১৬০০ টি। কম্বল ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০ টাকায়, চাঁদর প্রকারভেদে ১০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গের এই তাঁতি গোষ্ঠী আজও ধরে রেখেছে তাঁত সংস্কৃতি। ১৯৭৭ সাল থেকে এ হাট শুরু আদমদিঘী উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের শাওইল গ্রামে। হাট কেন্দ্র করে আদমদিঘী, দুপচাঁচিয়া, কাহালু, জয়পুরহাটর জেলার আক্কেলপুর, নওঁগাসদর উপজেলার অর্ধশত গ্রামের মানুষ এ পেশার সাথে জড়িত। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রাম শাওইল। এ গ্রামে ভিন্নধর্মী হাট গড়ে ওঠে। যার মুল শীতের চাদর কম্বল উলের (উলেন) সুতা কেনা-বেচা। পর্যায় ক্রমে এই হাটের প্রাচীনতা আর জনপ্রিয়তার জন্য এবং চাঁদর কম্বল মূলত এই হাটে বেচা-কেনা হয় বলে এই হাটের নাম দিয়েছে মানুষ “চাঁদর কম্বল হাটের গ্রাম”। ভোর রাত আনুমানিক ৪ টা থেকে শুরু হওয়া এই হাট চলে দুপুর পর্যন্ত। আর হাটের বার হলো রবি ও বুধ। তাছাড়া এই হাট বসে প্রতিদিনই। গোটা শীত মৌসুমে প্রায় ৪০ টি হাটে ৫০ কোটি টাকার বেচা কেনা হয়।
সারাবছর এ হাট ও তাঁত পল্লী চলমান থাকলেও শীত এলেই তাদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। পরিবারের সবাই মিলে একাজ করে বলে উৎপাদন খরচ কিছুটা কম হয়। এ শিল্পের কাজে বেশ মনোযোগ ও বাড়তি আয়ের জন্য পরিবারের স্কুল কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থীরাও কাজ করছে, পিতার ব্যবসায় প্রবৃত্তি বাড়াতে।
স্থানীয়রা জানান, খুব উন্নত মানের চাঁদর হওয়ায় এই চাঁদরের চাহিদা বাংলাদেশে ব্যাপক আর এই চাঁদর গুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও যায়। বিভিন্ন গার্মেন্টসের সোয়াটারের সুতা প্রক্রিয়া করে তাঁতে বুনিয়ে তৈরী হয় কম্বল, চাঁদর সহ আনুষাঙ্গিক পন্য। কোন ধরনের প্রচার ও সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল এই কর্মক্ষেত্র। চাঁদর তৈরীর পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীত বস্ত্র তৈরীর মেশিন, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাজারের আশপাশে গড়ে উঠেছে ছোট বড় অনেক দোকান। দোকানগুলোতে বেচাকেনায় নিয়োজিত কয়েক হাজার হাজার শ্রমিক। সপ্তাহের দুই দিন রবিবার ও বুধবার ভোর থেকে বেচাকেনা শুরু হয় হাটে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত ক্রেতারা আগের দিন এসে অবস্থান নেয় হাটের আশে পাশের বিক্রেতাদের বাড়িতে। সকাল ১০টার মধ্যেই চাহিদা মতো পণ্য কিনে ক্রেতারা রওনা দেন গন্তব্যের উদ্দেশে। হাটের হাজারাদাররা জানান, প্রতি হাটে প্রায় কোটি টাকার কম্বল, চাঁদর, উলের সুতা বিক্রি হয় সেখানে। হাটকে ঘিরে কর্মসংস্থান হয়েছে শতশত বেকারের। রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশ থেকে আসা ব্যবসায়ীদের চাঁদর কম্বল আর সুতা কেনার প্রতিযোগিতা।
সত্তর বছর বয়সী মকবুল হোসেন জানান, বাপ দাদার আমল থেকে তারা তাঁতী পেশায় রয়েছেন। আগে কটন সুতার কাজ করলেও এখন সোয়েটারের সুতা থেকে শীতবস্ত্র তৈরী করেন। গার্মেন্টের রিজেক্ট হওয়া সোয়েটার কেটে সুতা বের করে তাতে রং লাগিয়ে চড়কায় সুতা বুনে তাঁতে কম্বল, চাঁদর তৈরী করা হয় বলে তিনি জানান। এছাড়া গার্মেন্টের পুরাতন সুতা,উলের নতুন সুতা তারা শীতবস্ত্র তৈরীতে ব্যবহার করেন।
শাওল গ্রামের তাঁতী শাহীন, আনোয়ার, রফিকুল ইসলাম জানালেন, তারা একদিন সুতা কিনবে, তাতে রং করে শুকিয়ে নিয়ে প্রসেসিং করে তারপর তাঁতে উঠে বস্ত্র তৈরি হয়।
আশরাফুল ইসলাম, সেলিম পারভেজ, জাহাঙ্গীর আলমসহ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, শীতার্তদের মাঝে যারা কম্বল বিতরণ করেন তাদের অধিকাংশই যানে শাওইল গ্রামের কম্বলের হাটে। এখানে নেতা শাল ৬ হাত লম্বা যার মূল্য ৫শ থেকে ৬শ টাকা, লেডিস চাঁদর ৮০ থেকে ৪৫০ টাকা, অন্যান্য চাঁদরসহ শীতবস্ত্র বিক্রি করে তারা।
এ ব্যাপারে শাওইল হাট ও বাজার কমিটির সাধারন সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন জানান, প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত লট থেকে সুতা বাছাই, ফেটি তৈরী কিংবা সুতা সাজিয়ে রাখে। ঢাকা, চট্রগাম সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে সুতা নিতে আসে ক্রেতারা। তাঁত শিল্পিদের পর্যাপ্ত মুলধনের জোগান, সুস্থভাবে বাজারজাত করনের সুযোগ এবং ঠিকমতো কাচামাল সরবরাহ করলে এখনও আগের মত জনপ্রিয় আর গৌরবময় করে তোলা যায় এদেশের তাঁত শিল্পকে। এদেশের শিল্প সৌন্দর্যেও এক ধারাকে বাঁচানো যায় ধ্বংসের হাত থেকে। উৎপাদন খরচ বাড়লেও চাঁদর-কম্বলের দাম না বাড়ায় হতাশা ব্যক্ত করে তিনি ব্যাংক ঋন সহ সরকারী সুযোগ সুবিধার দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে বিসিক বগুড়ার উপ-মহাব্যবস্থাপক জাহেদুল ইসলাম বলেন, ওইসব ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ঋনের আবেদন করলে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋনের বিষয়ে সার্বিক সহায়তা করা হবে।
এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শীতবস্ত্র কিনতে যান ক্রেতারা। বাজারে চাহিদা প্রচুর। সেখান থেকে পণ্য পরিবহনেও কোন সমস্যা হয় না। তবে ওই এলাকার রাস্তাঘাট, ক্রেতাবিক্রেতাদের আবাসন সুবিধাসহ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানিয়েছেন ব্যবসায়ীসহ স্থানীয়রা।