নিজস্ব প্রতিবেদক: রমজান মাস শুরু হতে এখনো এক সপ্তাহ বাকি আছে। কিন্তু এরই মধ্যে বাজারে রমজাননির্ভর সব ধরনের পণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। ছোলা থেকে শুরু করে ডাল, ভোজ্যতেল, খেজুর, চিনি, পেঁয়াজ, মুরগি ও গরুর মাংস, গুঁড়াদুধসহ বেশ কিছু সবজির দরে বাড়তি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। যা ভোক্তাদের কাছে প্রায় অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তিন মাস ধরে ধাপে ধাপে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতোমধ্যেই সরকারের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ে ৪০টি নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসবে কোনো তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত মূল্যেই বিক্রি করে যাচ্ছেন অসাধুরা। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ এক রকম নির্বিকার। যদিও ভোজ্যতেলসহ কয়েকটি পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শাকসবজি, ছোলা, মুরগি ও গরুর মাংসসহ অন্যান্য পণ্যে বাড়তি দরের ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না সব পর্যায়ের বিক্রেতারা।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে অসাধু চক্র রোজার শুরুতে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে না। রমজান মাস শুরুর আগেই ওই চক্র মূল্য বৃদ্ধি করছে। এছাড়া অতি মুনাফা করে রোজায় মন্ত্রণালয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বৈঠক করছেন। পরে বৈঠকে দাম কমানোর নির্দেশ দিলে সঙ্গে সঙ্গে দাম কমাচ্ছেন। পাশাপাশি পণ্য মূল্য কমার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এর ক্রেডিট নিচ্ছে। তবে পণ্যের দাম কমানোর আগেই নির্ধারিত একটি সময় ধরে বাড়তি মুনাফা করে ভোক্তার পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ বছরও এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। এতে করে ভোক্তার চরম হাঁসফাঁস অবস্থার তৈরি হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর বাজার কাওরান বাজার, নয়াবাজার ও মালিবাগ কাঁচাবাজার ঘুরে ও খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে- গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি উন্নত মানের মসুর ডাল ৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। কেজিপ্রতি ছোলা ৫ টাকা, চিনি ২-৪ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৫-১০ টাকা, খেজুর ১৫০ টাকা, দেশি রসুন ৫ টাকা, শসা ৫ টাকা, কাঁচামরিচ ১০ টাকা, গরুর মাংস ১০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ফলের মধ্যে প্রতিকেজি সবুজ আপেল ৩০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি হালি (চার পিস) সাগর কলা মাসের ব্যবধানে ৫-১০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, রমজান এলে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এবারও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। তাই ভোক্তাকে স্বস্তি দিতে হলে সরকারের এখন থেকে কঠোরভাবে বাজার মনিটরিং করতে হবে।
রোজা উপলক্ষ্যে সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ে ৪০ নিত্যপণ্যের যৌক্তিক দর নির্ধারণ করেছে। তবে রাজধানীর খুচরা বাজারে এই যৌক্তিক মূল্যের চেয়ে সবগুলো পণ্যই বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এমনকি সংস্থাটির পক্ষ থেকে মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। তারা দর নির্ধারণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে এই সংস্থাটির নিজস্ব আইন থাকলেও তা অকার্যকর। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ভোক্তা অধিকার রক্ষায় বাজার তদারকি করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এই সংস্থার সঙ্গেও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সমন্বয় নেই। ফলে তদারকির ক্ষেত্রে কোনো সুফল আসছে না। তাই সব মিলে পণ্যের যৌক্তিক দর নির্ধারণ করলেও ভোক্তার কোনো উপকারে আসছে না। পণ্য কিনতে হচ্ছে সেই বাড়তি দরেই।
বুধবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে খুচরা পর্যায়ের জন্য ৪০টি নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে প্রতিকেজি উন্নত মানের মসুর ডালের দাম নির্ধারণ করা হয় ১২৬-১২৭ টাকা, কেজিপ্রতি ছোলা ৭০-৭২ টাকা, চিনি ৭৪ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ২৯-৩৬ টাকা, দেশি রসুন ৩৪-৪৫ টাকা, শসা ৩০-৪৪ টাকা, কাঁচামরিচ ৪৫-৬৭ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৫৫ টাকা দরে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ফলের মধ্যে প্রতিকেজি আপেল ১২৩-১৭৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর প্রতি হালি (চার পিস) সাগর কলার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২০-৩৪ টাকা। কিন্তু শনিবার এই দরে রাজধানীর খুচরা বাজারে পণ্য পাওয়া যায়নি।
এদিন রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি উন্নত মানের মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৩৫ টাকা। যা এক মাস আগে ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হয়। কেজিপ্রতি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮০ টাকা, যা এক মাস আগে ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক মাস আগে প্রতিকেজি চিনি ৭৬-৭৮ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮২ টাকা। কিছুটা দাম কমলেও প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা। যা মাসখানেক আগে ৩৫-৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা। যা এক মাস আগে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এমকে মুজেরি বলেন, রমজানের আগেই অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে দিশেহারা করে তোলে। কারণ বাজারে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় কোনো কিছু ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তাই তদারকি জোরদার করা দরকার।
শনিবার প্রতিকেজি শসা বিক্রি হয়েছে ৬৫ টাকা। যা এক মাস আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কাঁচামরিচ ৮০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়েছে, যা এক মাস আগের দাম ছিল ৭০ টাকা। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি সর্বোচ্চ ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৬৫ টাকা। পাশাপাশি ফলের মধ্যে প্রতিকেজি আপেল শনিবার ২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যার দাম মাসখানেক আগেও ২২০ টাকা ছিল। প্রতি হালি (চার পিস) সাগর কলা বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। যা এক মাস আগে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহয়িরার যুগান্তরকে বলেন, বাজারে তিন স্তরে তদারকি চলছে। ইতোমধ্যে ভোজ্যতেলসহ কিছু পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। আশা করছি অন্যান্য পণ্যের দামও কমে আসবে। তিনি বলেন, যে বা যারা রোজার আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে নাজেহাল করে তুলেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ আইনের বাইরে নয়। তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।