টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় নাকাল রাজধানীবাসী, শনিবারও থাকবে বৃষ্টি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দুই দিনের টানা ভারি বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তাঘাট। রাজধানীর নিচু এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। যেন ছোট-ছোট খালে পরিণত হয়েছে। এতে নগরীর কর্মব্যস্ত মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই।

রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকায় তৈরি হচ্ছে যানজট। ফলে গাড়িগুলো চলছে ধীরগতিতে। এ সময় পরিবহণ নিয়ে নগরবাসীকে তীব্র সংকটে পড়তে হয়। বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়ে পড়েছেন রাজধানীবাসী।

শুক্রবার ভোর থেকেই আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। রাজধানীতে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। ফলে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও আবাসিক এলাকায় জলজটের সৃষ্টি হয়।

রাজধানীর দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে কয়েকগুণ। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েও বের হয়েছেন কাজের সন্ধানে। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন তার সঙ্গে বৃষ্টির ফলে রাস্তাঘাটে মানুষের সংখ্যাও খুব বেশি দেখা যায়নি। ফলে তাদের আয়ও তেমন একটা হয়নি।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার এই দুদিন ধরে রাজধানীতে কখনো মুষলধারে, কখনো মাঝারি, কখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা ছাড়াও দেশের প্রায় সব জায়গায় অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি।

এমন বৈরী আবহাওয়ায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। শুক্রবার মধ্যরাত থেকেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট শুরু হয়। এছাড়া মিরপুর, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, খামারবাড়ি এলাকাতেও বিদ্যুৎ ছিল না।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে অলিগলির সড়ক পেরিয়ে পানি জমে গেছে মূল সড়কেও।

মৌসুমি বায়ু বেশি সক্রিয় থাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। ঝড়োহাওয়া বয়ে যাওয়ার শঙ্কায় চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরকে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। শুক্রবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ সতর্কবার্তায় পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সাগরের নৌযানগুলোকে উপকূলের কাছাকাছি এসে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীতে শুক্রবার ২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। তবে ঢাকার বাহিরে ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখানে এদিন ৩৭৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আগামীকাল শনিবারও বৃষ্টি থাকবে। তবে রোববার থেকে বৃষ্টি কমে যাবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা রয়েছে যেগুলো পরিকল্পিত। বাকি ৭০ ভাগ এলাকায় অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সরকারের রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার মধ্যেও বৈষম্য তৈরি হয়েছে। এতে জনক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার ভেতরে একটা শ্রেণির মানুষদের এভাবে দুর্ভোগে রেখে মধ্য আয়ের দেশে পৌঁছানো সম্ভব না।

এদিকে রাজধানীর ড্রেনেজ ব্যবস্থায় সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। ঢাকার খাল ও নর্দমাগুলো পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে তাদের মনোযোগ কম। ঢাকার উন্নয়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করা না হলে যে প্রকল্পগুলো হাতে নেওয়া হচ্ছে সেগুলো থেকে প্রত্যাশিত রিটার্ন আসছে না।

শুক্রবার সকালে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, বর্তমানে মৌসুমি বায়ুর অক্ষ পূর্ব-উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে।

পূর্বাভাস অনুযায়ী- পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে ।

আবহাওয়া গবেষকরা এ সময়ে এত বৃষ্টির জন্য কয়েকটি কারণ জানিয়েছেন, তার প্রথমটি হলো- দেশের স্থলভাগে বর্তমানে দুটি স্থানে নিম্নচাপ একত্র হয়ে প্রচুর জলীয় বাষ্প ও বাতাস টেনে নিয়ে আসছে।

দ্বিতীয়ত, বঙ্গোপসাগরে ভারত মহাসাগর দ্বিচক্রআইওডি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

তৃতীয়ত, মৌসুমি বায়ু বিদায় নেওয়ার সময়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে বিপুল পরিমাণে মেঘ জড়ো করছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদরা জানান, মৌসুমি বায়ুর বিদায় বেলায় সাধারণত বৃষ্টি বেড়ে যায়। এবার স্থলনিম্নচাপ এর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বৃষ্টি বেড়ে গেছে।

আবহাওয়াবিদরা আরও জানান, চলতি মাসের শুরুতে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে একই সময় দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। নিম্নচাপ দুটি দ্রুত স্থলভাগে উঠে পড়ে। আরব সাগরেরটি মুম্বাই দিয়ে এবং বঙ্গোপসাগরেরটি পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে স্থলভাগে উঠে যায়। পরে দুটি একত্র হয়ে গতকাল ভারতের সিকিম হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দিয়ে রাজশাহীতে ঢোকে। আর তাই গতকাল রাজশাহীতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। গতকাল এটি আরও শক্তিশালী হয়ে ময়মনসিংহ হয়ে কিশোরগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে সিলেটের দিকে এগোয়। এ কারণে আজ ও আগামীকাল ওই এলাকায় বেশি বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

দ্বিতীয়ত, ভারত মহাসাগরে এরই মধ্যে ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র বা ইন্ডিয়ান ওশেনডাইপল-আইওডি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি সক্রিয় হলে সাগরের মাঝখানের অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এতে জলীয় বাষ্প বেড়ে যায়, যা একজোট হয়ে ভূ-খণ্ডের দিকে আসতে থাকে। দুই মাস ধরে আইওডি সক্রিয় থাকায় ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প আসা বেড়ে গেছে।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ থেকে মৌসুমি বায়ু বিদায় নিতে শুরু করেছে। মৌসুমি বায়ুর অগ্রভাগ এবং পশ্চাৎভাগে জলীয় বাষ্প এবং মেঘ বেশি থাকে। ফলে জুনের মাঝামাঝি সময়ে এটি যখন টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন প্রচুর বৃষ্টি হয়। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে যখন বাংলাদেশ ছেড়ে যায়, তখনো প্রচুর বৃষ্টি ঝরায়।

সাধারণত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তা বাংলাদেশ ভূ-খণ্ড ছেড়ে যায়। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে আসা নিম্নচাপের কারণে এটি এবার শেষ সময়ে এসে আবারো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। যে কারণে বাংলাদেশের ভেতরে প্রচুর জলীয় বাষ্পসহ মেঘ জড়ো হয়ে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title