নিজস্ব প্রতিবেদক: উৎসবমুখর পরিবেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে। এই ঈদে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পশু কোরবানি করেন এবং পরিবার-স্বজনদের নিয়ে কোরবানির মাংস খাওয়ার উৎসবে মাতেন। তবে উৎসবকে ঘিরে অতিমাত্রায় লাল মাংস খাওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে আনন্দের পবিত্র ঈদ যেন বিষাদে রূপ না নেয়, সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকারও পরামর্শ তাদের।
চিকিৎসা পরিভাষায়, গরু, খাসি, মহিষ, ভেড়ার মাংসকে লাল মাংস বা রেড মিট বলা হয়ে থাকে। এসব মাংসে মায়োগ্লোবিন নামক উপাদান বেশি থাকার কারণে মাংস লাল হয়। এই মাংসে উচ্চমাত্রার চর্বি ও কোলেস্টেরল থাকায় খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি থেকে যায়। তাই রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্ক হয়ে রেড মিট খাওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত তাদের।
লাল মাংসে যাদের ঝুঁকি বেশি
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, হৃদরোগীদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা উচিত তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্যই। যেসব মানুষের অলরেডি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, যাদের হার্টে রিং পরানো আছে, যাদের হার্টে বাইপাস হয়েছে এবং যাদের জন্মগত হার্টের ঝুঁকি আছে, এই ধরনের লোকদের আমরা সবসময়ই পরিমিত আহারের কথা বলে থাকি।
এছাড়াও যাদের ডায়াবেটিস আছে, রক্তচাপ আছে এবং রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি আছে, তাদেরকেও খাবার-দাবারে সতর্কতার কথা বলি। বিশেষ করে রেড মিট বা লাল মাংসের বিষয়ে সচেতন করে থাকি।
তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু ঈদ নয়, রেড মিটকে সবসময়ই এভোয়েড করতে বলি, কারণ এগুলোতে প্রচুর চর্বি থাকে। আর এই চর্বিগুলো খাওয়া হলেই রক্তে গিয়ে জমে যায় এবং হৃদরোগের অংশটাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।’
ডা. প্রদীপ কুমার বলেন, ‘ঈদের সময় অনেকে একসঙ্গে বেশি পরিমাণ মাংস খেয়ে ফেলে, যে কারণে আমরাও এই সময়টাতে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি পাই। আমরা তো প্রতি ঈদেই হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করি, এই সময়টাতে আমরা দুই ধরনের রোগী বেশি পাই। এর মধ্যে কিছু রোগী আসে গরু জবাই করতে গিয়ে ধস্তাধস্তিতে অসুস্থ হয়, আর বাকিরা আসে অতিরিক্ত খাবার-দাবারে অসুস্থ হয়ে।’
দিনে কয় টুকরো মাংস খেতে পারবেন?
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, ‘অনেকেই মনে করে ঈদ উপলক্ষ্যে মাংস খেলে কিছুই হবে না। এমনকি এক পর্যায়ে এভাবে সে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি মাংস খেয়ে ফেলে এবং অসুস্থ হয়ে হৃদরোগ হাসপাতালে ভর্তি হয়। সুতরাং ঈদের সময় খাবার দাবারের জন্য সবাই যেন সতর্ক থাকে এবং পরিমিত আহারের বিষয়ে খেয়াল রাখে, এই পরামর্শটা আমরা দিয়ে থাকি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদুল আজহায় গরুর মাংস এবং খাসির মাংসটাই বেশি খাওয়া হয়। আমরা আমাদের রোগীদেরকে সবসময় এ মাংসগুলো যথাসম্ভব এভোয়েড করার কথা বলি। আর কেউ খেলেও খুবই পরিমিত, একসাথে সর্বোচ্চ এক বা দুই পিস এবং দিনে সর্বোচ্চ তিন-চার পিস। এক্ষেত্রেও আমরা ঝোলটাকে এভোয়েড করতে বলি, কারণ রান্নার পর মাংসের চর্বিটা ঝোলের মধ্যে চলে আসে। এজন্য আমরা জোর দিয়ে বলি কেউ যদি ঈদ উপলক্ষ্যে খেতে চায় এক দুই পিস খেতে পারবে, তবে কোনোভাবেই ঝোল খাওয়া যাবে না।
একজন সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তির দিনে কতটুকুর বেশি মাংস খাওয়া উচিত নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একজন সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তি দিনে সর্বোচ্চ ৮০ থেকে ১০০ গ্রাম মাংস খেতে পারে। এর বেশি খেলেই ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে। আমরা বলি যে, একজন স্বাভাবিক ব্যক্তি চার অংশ কার্বোহাইড্রেট, এক অংশ প্রোটিন এবং এক অংশ ফ্যাট খেতে পারবে। কিন্তু যারা হৃদরোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে আরও কম খেতে বলি। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম, অর্থাৎ তিন-চার টুকরো খেতে পারবে। কোনোভাবেই এর বেশি খাওয়া যাবে না।
ডায়াবেটিস রোগীদের ‘পোলাও-মিষ্টি’ নিয়েই ভাবতে হবে
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলোজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা ডায়াবেটিসের রোগী তারা ঈদে কোরবানির মাংস পরিমাণের বেশি খাবে না। কারণ ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে একটি বড় সমস্যা হলো কোলেস্টরেল, যা লাল মাংসে অতিমাত্রায় থাকে। কেউ যদি খেতে চায় তাহলে সারাদিনে সর্বোচ্চ দুই পিস খেতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো ঝোল এবং চর্বি খাওয়া যাবে না। তাছাড়া যাদের ডায়াবেটিসের কারণে কিডনিজনিত সমস্যা আছে, তারাও সারাদিনে এক-দুই পিসের বেশি খাবে না।
তিনি বলেন, যাদের ডায়াবেটিস আছে, তবে রিচফ্যাক্টর নেই, তারা পরিমিতমাত্রায় খেতে পারে। তবে সলিড মাংস খেতে হবে, চর্বি বা ঝোল নয়।
আতিকুর রহমান আরও বলেন, ঈদকে কেন্দ্র করে শুধু গরুর মাংস নয়, প্রচুর পরিমাণ পোলাও খাওয়া হয়। এছাড়া এই সময়টাতে প্রচুর পরিমাণ মিষ্টি খাওয়ারও প্রচলন আছে। সেই সঙ্গে যেহেতু এখন আমের সিজন, এটাও বেশ পরিমাণ খাওয়া হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মাংস যতটা ঝুঁকিপূর্ণ, মিষ্টি জাতীয় এসব খাবারও ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রতিদিন মাংস নয়, দুই-তিন পিসের বেশি নয়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাংস তো কোরবানির ঈদে কিছু খাবেই, তবে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া যাবে না। কারণ, গরুর মাংস, খাসির মাংসে এক ধরনের খারাপ চর্বি আছে। কলিজাতেও চর্বি আছে। খাওয়ার পর এই চর্বিটা যদি জমে যায়, তাহলে তো সমস্যার কারণ হতেই পারে। এজন্য ঈদে মাংস খেলেও পরিমাণমতো খেতে হবে।
তিনি বলেন, ঈদে লাল মাংসটা প্রতিদিন নিয়ম করে খাওয়া যাবে না। একদিন খেলেন, এরপর কিছুটা গ্যাপ দিয়ে খেতে হবে। আপনি যদি টানা এক সপ্তাহ খেতেই থাকেন, তাহলে নিশ্চিত আপনি ঝুঁকিতে পড়বেন। ঈদ উপলক্ষ্যে এই মাংসগুলো গ্যাপ দিয়ে সর্বোচ্চ দুই-তিনদিন এক-দুই টুকরা করে খেতে পারেন।
রোবেদ আমিন বলেন, কোরবানির ক্ষেত্রে তো ইসলামিক কিছু নিয়ম আছে, কোরবানির মাংসটা আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ভাগ বণ্টন করতে হয়। ইসলামিক নিয়মটা মানলেই একসঙ্গে আর দীর্ঘদিন মাংসটা খাওয়া হয় না। আর যদি খেতেই হয়, তাহলে ফ্রিজে রেখে গ্যাপ দিয়ে খেতে হবে। পাশাপাশি এই সময়টাতে ডায়াবেটিস এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে কি না নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্বাভাবিকভাবে আমরা যেমনটা দেখি, দেশের অধিকাংশ মানুষেরই ডায়াবেটিস-হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে থাকছে না, ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছে না। এর মধ্যে যদি আবার ঈদ উপলক্ষ্যে মাংসটাও খায় ইচ্ছে মতো, তাহলে সমস্যায় পড়ে যেতে হতে পারে।
স্ট্রোক-হার্ট অ্যাটাক হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই পরিচালক বলেন, আমাদের দেশে ইমারজেন্সি সিস্টেমটা এখনো সেভাবে ডেভেলপ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে কেউ স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক করলে দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, তাহলে রোগীর জন্য লাইভ সেভিং হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমাদের ইমারজেন্সি কল সেন্টার ৯৯৯ নম্বরের সহযোগিতা নিতে হবে।
তিনি বলেন, হার্ট অ্যাটাক যদি হয় তাহলে তো সিসিইউ যেখানে আছে, সেখানে নিতে হবে। এর বাইরে চিকিৎসা নিয়ে কোনো লাভ নেই। আর স্ট্রোকের জন্য আমাদের নিউরোসায়েন্স হসপিটাল আছে, সেখানে স্ট্রোকের জন্য আলাদা ১০০ বেডের একটা স্ট্রোক ইউনিট আছে। সেখানে যদি স্ট্রোক করার চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যেও নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে একটা ইনজেকশন আছে যেটা দিলে লাইফটা সেফ হয়ে যাবে। কিন্তু ওই সময়ের পরে গেলে তো আর ইনজেকশনটা দেওয়া যায় না বা দিলে কাজও করবে না। এজন্য মানুষকে জানাতে হবে যে আমাদের নিউরোসায়েন্স হসপিটালে এই ব্যবস্থাটা আছে।
‘এছাড়াও অন্যান্য যেসব হাসপাতালে স্ট্রোক ইউনিট আছে, সেগুলোতেও যদি সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে রোগী পৌঁছাতে পারে তাহলে একটা ভালো ব্যবস্থা আছে, তারা প্যারালাইসিসের আগেই প্রিভেনশন করতে পারবে।’
স্ট্রোক-হার্ট অ্যাটাকের কারণ প্রসঙ্গে ডা. রোবেদ আমিন বলেন, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, খাদ্যাভ্যাস, ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটি, এয়ার পলিউশন-এই পাঁচটা রিচফ্যাক্টর কমন। এগুলোকে সব সময় অ্যাড্রেস করতে হবে। বিশেষ করে কারো যদি হাইপারটেনশন থাকে, তাকে সবসময় রক্তচাপের ওষুধ খেয়ে যেতে হবে এবং সবসময় ডাক্তারের ফলোআপে থাকতে হবে। ওষুধের পাশাপাশি লাইফস্টাইল মডিফিকেশনের দিকেও মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই কিন্তু স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মাত্রা কমে যাবে।
প্রসঙ্গত, গবেষণায় দেখা গেছে, একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন গড়ে ১০০ গ্রাম লাল মাংস খেতে পারেন। কিন্তু যাদের পাকস্থলীতে আলসার রয়েছে তারা লাল মাংস খেলে তাদের রোগ বাড়িয়ে দেয়। তাদের উচিত হবে প্রোটিনের বিকল্প উৎসের দিকেই অধিক মনোযোগী হওয়া। আর কিডনি ফেইলিউরের রোগীরা প্রতিদিন ৩০ গ্রাম প্রোটিন খেতে পারবেন। আর যারা ডায়ালাইসিস করেন তারা পারবেন ৭০ গ্রাম মাংস খেতে। সাধারণত কিডনি রোগীরা লাল মাংস খাবেন কি না, সেক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেবেন।
তবে যাদের অপারেশন হয়েছে বা শরীরে কোনো গভীর ক্ষত আছে, তারা ১০০ গ্রামের বেশি লাল মাংস খেতে পারেন। সেক্ষেত্রে গেঁটে বাতের রোগীরা লাল মাংস খাবেন না। লাল মাংস রক্তে ইউরিক এসিডের মাত্রা বাড়িয়ে দেবে। আর যারা হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বা স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন তাদের লাল মাংস এড়িয়ে যাওয়া ভালো। তারা প্রোটিনের জন্য মাছ-মুরগির মাংস খেতে পারেন। আর লিভারের রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী লাল মাংস খাবেন।