রাসেল হাওলাদার, বরগুনা প্রতিনিধি : বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ১৪ কিশোর আসামির মধ্যে রয়েছে এ প্লাস প্রাপ্ত তিন মেধাবী মুখ। তিনজনই পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছে গোল্ডেন জিপিএ-৫।
এছাড়াও ক্রিকেট, হ্যান্ডবল, দৌঁড়, দাবা ও হকি খেলায় পারদর্শীতার সাফল্য রয়েছে এ কিশোরদের মধ্যে অনেকেরই। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জন সুযোগ পেয়েছে বরগুনা জেলা ক্রিকেট ও হকি দলের খেলোয়ার হিসেবে।
বরগুনার একটি সচেতন মহল বলছেন, সন্তানের অবক্ষয়ের পেছনে শুধু পরিবারই নয়, বরং এ সমাজও দায়ী। সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক মেরুকরণ আর সর্বনাশা মাদকের ছোবলে অদম্য মেধাবী ও প্রতিভাবান এসব কিশোর আজ অন্ধকার জগতে ধাবিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অহেতুকভাবে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বাধ্য করা হয় রাজনৈতিক মিছিল, মিটিং এ অংশ নিতে। এমনকি শিক্ষকদেরো চাপে ফেলে এসকল কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করতে হুকুম জারি করা হয় উপর মহল থেকে। ফলে বিপাকে পড়তে হচ্ছে এমন কচি মনের শিশুদের। যারা অজান্তেই জড়িয়ে যায় বিভিন্ন মামলা-মোকদ্দমায়।
এসকল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয় কোমলমতি শিশুরা। গর্বিত এই বাংলাদেশের সেরাদের তালিকা থেকে হয়ে যায় অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের নিকৃষ্ট অংশিদার। গড়ে ওঠার আগেই ভেঙ্গে যায় জীবনের বড় বড় স্বপ্নগুলো। হয়ে ওঠে পরিবার তথা সমাজের সবথেকে নষ্ট একটি সন্তান। আসলে এ নষ্টের পেছনে কী শুধু পরিবার কিংবা ওই শিশুটিই দায়ী? রাজনীতির এমন ভয়াল গ্রাস থেকে এসকল শিশুদের রক্ষা করা এ সমাজেরই দায়িত্ব বলে মনে করছেন বরগুনার স্থানীয় সচেতন মহল। রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় জড়িয়ে পড়া পুলিশের খাতায় রিশানের অপরাধের চিত্র উঠে এলেও; উঠে আসেনি একজন অদম্য মেধাবী রিশানের ঈর্ষণীয় ফলাফলের তথ্য। উঠে আসেনি পিএসসি, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় তার গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর। উপস্থিত বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা ও বিতর্কে ছিলো এক অসাধারণ প্রতিভা। একজন মেধাবী রিশানের অপরাধী হয়ে ওঠার গল্পের চিত্র ফোটানোর চেষ্টা করে অনেকেই। কিন্তু ঘটনার অন্তরালের ঘটনা কী কেউ জানতে চায়? সেরা কাজগুলো সহজে প্রাধান্য না পেলেও; খারাপগুলো অতি সহযেই খুঁজে বেড়ান এ সমাজের নিন্দুকরা। নিন্দুক থাকা ভালো, তবে অতি উৎসাহী নিন্দুক থাকা একটি পরিবারের ধ্বংশের মূল কারণও হতে পারে।
শুধু রিশান নয়; পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসিতে রিশানের মতো গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে এ মামলার অপর দুই কিশোর আসামি মো. রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার ও মো. নাঈম।
মো. নাঈম এর বাবা সেন্টু চৌকিদার বলেন, আমরা অত্যন্ত গরিব পরিবার। রোজ আনি রোজ খাই। তবে না খেয়ে থাকাটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ালেও, আমার তিন সন্তানদের জন্যই আয় করতে হয়। নাঈম পঞ্চম শ্রেণি থেকে শুরু করে এসএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত তার ফলাফল জিপিএ-৫। কিন্তু আজ এই রাজনৈতিক অপসংস্কারের কারণে সোনালী স্বপ্নগুলো মেঘে ঢেকে গেছে। এর দায়ভার কে নেবে?
রিফাত হাওলাদার এর বাবা আবদুল হালিম বলেন, লেখাপড়া ও খেলাধূলা ছিলো তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। পড়ালেখায় ভালো হওয়ার কারণে পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসিতে রেজাল্ট দাঁড়িয়েছে জিপিএ-৫। লেখাপড়ার পাশাপশি হ্যান্ডবল, দৌঁড়, হকি ও বলিবলে ছিলো বিশেষ পারদর্শীতা। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত বাংলাদেশ ইয়ূথ গেমস্-১৮ এ হ্যান্ডবল খেলোয়ার হিসেবে অংশগ্রহনকারীও ছিলো এই রিফাত। বরগুনা জেলা হকি দলেও ছিলো সুনাম অর্জণকারী একজন খেলোয়ার হিসেবে। সাংসারিক কর্মদক্ষতায়ও ছিলো বেশ চৌকস। আজ স্বপ্নের সোপন ছোঁয়ার আগেই সিড়িটা ভেঙ্গে গেলো।
রিশান ফরাজীর মা রেশমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, বিগত পরীক্ষার মতোই এইচএসসি পরীক্ষায় অটোপ্রমোশন দেয়া হয়েছে। এখন রিশান এইচএসসিতেও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাবে। রিশান সবসময় বলতো ‘আম্মু আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব।’ অথচ নষ্ট রাজনীতির কারণে আমার মেধাবী ছেলের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, রিফাত হত্যা মামলায় ১৪ জন কিশোর আসামি জড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে অনেকেই সম্ভাবনাময় অদম্য মেধাবী। এরকম মেধাবীরাই শিক্ষাজীবন শেষে বড় পদে আসীন হবেন। অথচ উঠতে গিয়েই দেবে গেলো জীবনের এক মহামূল্যবান সময় ও অংশ।
এ বিষয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বরগুনার সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান বলেন, সামাজিক দায়িত্ব, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বের মাধ্যমে এরকম মেধাবীদের আমরা গড়ে তুলতে পারছি না। পরিবারের যে দায়িত্ব পালন করার কথা, অনেক সময় সামাজিকভাবে তারাও সে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হন। এর ফলে মেধাবীরা বিপথগামী হচ্ছে। এ দায় শুধু পরিবারের নয়; এ দায় সমাজের, রাষ্ট্রেরও।