নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘মহামারির কারণে দুই বছর আসা হয়নি জাতীয় স্মৃতিসৌধে। এবার আর স্বাধীনতা দিবসের সকালে ঘরে থাকতে পারিনি।’ গতকাল শনিবার এভাইে বলছিলেন সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী নাদিম। স্ত্রী, স্কুলপড়ূয়া দুই সন্তান নিয়ে চলে এসেছেন দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা বাঙালির সূর্যসন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতে। এবার করোনাজনিত সরকারি কড়াকড়ি নেই, তাই হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছেন প্রাণের টানে।
আলো-আঁধারির ভোর থেকেই মানুষের যে ঢল শুরু হয়েছিল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল-সন্ধ্যায়ও তা শেষ হয়নি। দুপুরের আগেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শ্রদ্ধাবেদি। সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে এসেছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক শরীরে জড়িয়ে। তবে ৬০ ফুট দীর্ঘ জাতীয় পতাকা বহন করে স্মৃতিসৌধে আসা গাজীপুরের ইকবাল সিদ্দিকী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে। শত হৃদয়ের স্পর্শে, মুক্তিযুদ্ধ দিনের সেই রক্ত কাঁপানো স্লোগানে স্লোগানে স্মৃতিসৌধ চত্বরে যেন জেগে উঠেছিল একাত্তরের বাংলাদেশ।
জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকের বাইরের রাস্তায় জাতীয় পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন হাতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের মানুষের সারি শুরু হয়ে যায় সেই সকাল থেকে। সবারই অপেক্ষা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হওয়ার।
ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। এরপরই শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। এ সময় সশস্ত্র সালাম জানায় সশস্ত্র বাহিনীর সুসজ্জিত চৌকস দল। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, তিন বাহিনীর প্রধান, মুক্তিযোদ্ধা, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা এবং বিদেশি কূটনীতিকরা। প্রথম দফা শ্রদ্ধা নিবেদনের পর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে আবারও দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধান ফটক খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। শুরু হয় জনস্রোত। ‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, হারিয়ে যেতে দেব না’, ‘বীর বাঙালির রক্ত বৃথা যেতে পারে না’, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, রাজাকারের ঠাঁই নাই’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। শুধু বিভিন্ন সংগঠন নয়, পরিবার-পরিজন নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও স্মৃতিসৌধে আসেন শত শত মানুষ। জনতার এই ঢল প্রমাণ করে জাতি একাত্তরের বীর শহীদদের ভুলে যায়নি, যেতে পারে না।
অসংখ্য সংগঠন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যানারের ভিড়ে সবার নজর কাড়ে গাজীপুরের ইকবাল সিদ্দিকী স্কুল অ্যান্ড কলেজেরে শিক্ষার্থীরা। আড়াইশ শিক্ষার্থী বহন করে নিয়ে আসে ৬০ ফুট দীর্ঘ বিশাল পতাকা। কপালে জাতীয় পতাকা বাঁধা ব্যান্ড, কারও কারও মুখে ও হাতে লাল-সবুজের উল্ক্কি আঁকা। কলেজ অধ্যক্ষ ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, ‘৬০ ফুট দীর্ঘ জাতীয় পতাকা তৈরির এই আইডিয়া শিক্ষার্থীদের। কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই আইডিয়া বাস্তবায়নে সাধ্যমতো সহায়তা করেছে। তরুণদের হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জিত হবে, এটাই প্রত্যাশা।
সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাভারের হলি সোল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থীরাও। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তারা সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশ করে। এ সময় স্মৃতিসৌধ চত্বরে উপস্থিত শত শত মানুষ কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়িয়ে যায়, তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে অংশ নেয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শ্রদ্ধা :সকালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে শেখ হাসিনা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, শাজাহান খান ও জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী এবং দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ূয়া। আওয়ামী লীগ নেতাদের পরপরই দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের কাছে জাতির অন্যতম প্রধান দাবি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেই বিচার শেষ হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের এ বিচার চলমান থাকবে, ধাপে ধাপে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।’
পরে দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি বলেন, ‘৫০ বছর পর যখন স্বাধীনতা দিবস পালন করা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়েছে। এক কঠিন কর্তৃত্ববাদী শাসনে চলছে দেশ। এখন জনগণের ভোটের অধিকার নেই, কথা বলার স্বাধীনতা নেই, যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার সবকিছু ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।’
শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম বলেন, ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করার সময় যে দেশ দেখার স্বপ্ন ছিল, সে দেশ আজও পাইনি। স্বাধীনতার ৫১ বছরে আজ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি তা ‘অপ্রত্যাশিত’। এখনও শ্রেণিবৈষম্য, দলবৈষম্য প্রকটভাবে বিদ্যমান।’ এই বৈষম্যের জন্য তিনি তার ভাষায় ‘লুটেরা রাজনীতিবিদ’ ও ‘লুটেরা আমলাদে’র দায়ী করেন।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বাংলাদেশ যেভাবে এগোচ্ছে, সেভাবে এগিয়ে নিতে হলে সামনের বাংলাদেশ সুশাসনের বাংলাদেশ করতে হবে। তার জন্য কঠোরভাবে দুর্নীতির সমস্যা ও দলবাজির সমস্যা, বৈষম্য এবং দরিদ্রতার সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘দেশে আজ কোনো গণতন্ত্র নেই, অথচ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরুই হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। দেশে এখন সীমাহীন দুঃশাসন, দুর্নীতি চলছে। একই সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে, দারিদ্র্য বেড়েছে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘দেশে এখন সাম্যের জায়গায় অসাম্য ও বৈষম্যের পাহাড় তৈরি হয়েছে। সামাজিক ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।’
এ ছাড়া জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
অন্যান্য সংগঠনের শ্রদ্ধা: জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টসহ অসংখ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ এখনও আছে। তবে এ চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ যখন থাকবে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ থাকবে, তখন যে কোনো বাধা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করা কঠিন কিছু হবে না।’
জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে দেশাত্মবোধক গান, বাউলগান, আবৃত্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকলা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষ শিল্পকলা একাডেমির এ আয়োজনে অংশ নেন।