ব্রাহ্মণডুরা ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিবের নতুন কারিশমা : জন্ম নিবন্ধনের তথ্য সার্ভার থেকে গায়েব

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি :: অপরাধীরা নিজের অপরাধকে ঢাকতে করে থাকে একের পর এক নাটক। নেয় ভিন্ন কৌশল। একটি জন্ম নিবন্ধনকে ঘিরে ঘটছে একরে পর এক নাটক। নেয়া হচ্ছে নানা কৌশল। তীর ছুটা হচ্ছে এক পক্ষ আরেক পক্ষের প্রতি। তবে এর শেষ কোথায় জানে না কেউ। নতুন নতুন অধ্যায় আসছে সামনে। আর এসব নাটক দেখে হতবাক হচ্ছে সাধরণ মানুষ। হাটে বাজারে পাড়া মহল্লায় একটাই আলোচনা কে কাকে ঠকাচ্ছে? সরকারের জনপ্রতিনিধি ঠকছে নাকি জনগন প্রতিনিধির কাছে ঠকছে? এমন প্রশ্ন এখন সাধারন মানুষের মুখে।
শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার ১১নং ব্রাহ্মণডুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হোসেইন মুহাম্মদ আদিল জজ মিয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করে একের পর এক নতুন নতুন নাটক করে যাচ্ছেন জনগনের সাথে। এ যেন ভারতীয় সিনেমাকেও হার মানাচ্ছে এই নাটকীয় অভিনয়ের কাছে। এবার জজ মিয়া খোদ সরকারের সাথেই করছেন নাটক। সাথে যুক্ত হয়েছেন ১১নং ব্রাহ্মণডুরা ইউপি ও অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ৭নং নুরপুর ইউপি সচিব স্বজল চন্দ্র দত্ত। ভুয়া জন্ম নিবন্ধন তৈরী করে যেমন আলোচনার পাত্র সেজেছেন ঠিক তেমনী আবার জন্ম নিবন্ধনের তালিকা সার্ভার থেকে মুছেও জন্ম দিচ্ছেন আরেক নতুন আলোচনা। এযেন সকরারের সাথে প্রতারণা।
ঘটনার সুত্রে জানাযায়, ২০১৭ সালে বি-বাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার আড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মৃত সৈয়দ আহাম্মদের পুত্র মাওলানা নুর মোহাম্মদ ব্রাহ্মণডুরা ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় মসজিদের জন্য ইমাম হিসেবে নিয়োগ নেন। পাশাপাশি শাহজালাল দাখিল মাদ্রাসার সুপারের দায়িত্বও নেন। ঐসময়ে অত্র ইউনিয়নের কাজীপদটি শুন্য হলে নিয়োগ প্রদান করে উপজেলা প্রশাসন। নিয়োগের শর্ত দেয়া হয় প্রত্যেক আবেদনকারী স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। ঐ পদে নিয়োগের জন্য ১০জন প্রার্থী আবেদন করলে নাসিরনগর উপজেলার বাসিন্দা নুর মোহাম্মদও নিয়মবহির্ভূতভাবে আবেদন করেন। নিয়োগ বোর্ডে পরিক্ষাও দেন নুর মোহাম্মদ। আবেদনের সময় নুর মোহাম্মদ নাসিরনগরের বাসিন্দা থাকা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণডুরা ইউনিয়নের চারিত্রিক সনদপত্র, ইউনিয়ন নাগরিক সনদপত্র ও ১৯৮৭৩৬১৪৪৪৭০২১৪৫৪ সিরিয়ালের একটি জন্মনিবন্ধন আবেদনের সাথে দাখিল করেন। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জন্ম নিবন্ধনটি ২০০৫ সালে নিবন্ধন করা হয় তথকালীন ৭নং নুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা আলহাজ্ব গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বেলালের সময়। কিন্তু জন্ম নিবন্ধনে ইউপি সচিব স্বজল চন্দ্র দত্তের স্বাক্ষর সঠিক থাকলেও চেয়ারম্যান বেলালের স্বাক্ষরটি দেয়া হয় জাল। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণডুরা ইউপি চেয়ারম্যান জজ মিয়াকে অবহিত করা হলে চেয়ারম্যান জজ মিয়া কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো ভুয়া জন্ম নিবন্ধনকারী নুর মোহাম্মদের পক্ষে সাফাই গাইতে থাকেন। এবং ঐ সময় নুর মোহাম্মদ প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ব্রাহ্মণডুরা ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা ও অত্র ইউনিয়নের জন্ম নিবন্ধনকারী হিসেবে দৈনিক খোয়াই পত্রিকায় একটি প্রতিবাদ প্রকাশ করেন। এছাড়া সাজিবের নামে নুর মোহাম্মদ শায়েস্তাগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়রিও করেন। এক ভিডিও বার্তায় নুর মোহাম্মদ বলেন, এসব কিছুর মুলে রয়েছে চেয়ারম্যান জজ মিয়া।
তার নাগিরিকত্বকে চ্যালেঞ্জ করে ওই ইউনিয়নের সচেতন নাগরিক এস এম ফখরুদ্দীন আহম্মদ সাজিব বাদী হয়ে হবিগঞ্জ জুডিশিয়াল কোর্টে একটি মামলা দায়ের করলে আদালত মামালটি তদন্ত করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেন। যা এখনো তদন্তাধীন রয়েছে। পরে নুর মোহাম্মদের পক্ষে এস এম ফখরুদ্দীন আহম্মদ সাজিবের নামে পুরাইকলা বাজারে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জজ মিয়া একটি প্রতিবাদ সভা করেন। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চেয়ারম্যান জজ মিয়া বিভিন্ন কৌশল অবলম্বনসহ করছেন একের পর এক নাটক।
নুর মোহাম্মদের জন্ম নিবন্ধনটি যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায় আবেদনকৃত নিবন্ধন ১৯৮৭৩৬১৪৪৪৭০২১৪৫৪ নম্বরটি নুর মোহাম্মদের নামে অনলাইনে এনিট্র করা রয়েছে। কিন্তু ইউনিয়নের রেজিস্ট্র খাতায় নুর মোহাম্মদ নামের কোন অস্থিত্ব নেই।
নুরপুর ইউনিয়নে দায়িত্বে থাকা সচিব সবিনয় দাশের কাছ থেকে গত ৬ জানুয়ারী নিবন্ধনকৃত ১৯৮৭৩৬১৪৪৪৭০২১৪৫৪ নম্বরে নুর মোহাম্মদ নামে অনলাইন থেকে একটি কপি ইউনিয়ন রশিদসহ সংগ্রহ করা হয়। যা আদালতেও জমা দেয়া হয়। সবিনয় দাশ নুরপুর ইউনিয়ন থেকে বিদায় নিলে ব্রাহ্মণডুরা ইউনিয়নের সচিব স্বজল চন্দ্র দত্ত ঔই ইউনিয়নের দায়িত্ব নিলে গত ২০ আগস্ট ১৯৮৭৩৬১৪৪৪৭০২১৪৫৪ সিরিয়াল নম্বরে নুর মোহাম্মদ নামে আরেকটি কপি তুলতে গেলে দেখা যায় মারুফ চৌধুরী নামে এন্ট্রি করা আছে। ঐ নাম্বারেই গত ৬ জানুয়ারী নুর মোহাম্মদ নামে জন্ম নিবন্ধন কপি তুলা হয় একই অফিস থেকে। কিন্তু হঠাৎ করে ১৯৮৭৩৬১৪৪৪৭০২১৪৫৪ আবার মারুফ চৌধুরী নামে হয়ে গেল কি করে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।
এ বিষয়ে জানতে নুর মোহাম্মদ মুঠোফেনে জানান, আমি কিছু জানি না। আমি নাসিরনগরের বাসিন্দা। কিন্তু চেয়ারম্যান জজ মিয়া আমাকে কাজী নিয়োগ পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে ঔইখানকার বাসিন্দা বানাবে বলে আমার কাছ থেকে ৬লাখ টাকা নেন। বিনিময়ে আমাকে একটি জন্ম নিবন্ধন, ইউনিয়নের নাগরিক সনদ, চারিত্রিক সনদ দেন। আমি জমি বিক্রি করে তাকে টাকা দেই। কিন্তু আমার টাকাও ফেরত দেয়নি, চাকরিও দেয়নি বরং আজ সে আমাকে মসজিদ থেকেও বিতারিত করেছে। এ বিষয়ে নুরপুর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দীক জানান, জন্ম নিবন্ধন পরিবর্তনের জন্য আমার কাছে কেউ আসেনি। এব্যাপারে সচিব ভালো বলতে পারেন।
সাবেক সচিব সবিনয় দাশ জানান, আমি দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে নুর মোহাম্মদ নামে অনলাইনে এন্ট্রি পেয়েছি। আমি আসারপর কিভাবে নুর মোহাম্মদ থেকে মারুফ চৌধুরী হল সেটা আমি জানি না। তবে আমার জানামতে নাম ঠিকানার ভুলক্রটি সংশোধন করা গেলেও একই নাম্বারে দুইজন ব্যক্তির নিবন্ধন করা সম্ভব নয়।
একই জন্ম নিবন্ধনের সিরিয়াল নাম্বার দুইজনের নামে কি করে এমন পরিবর্তন হলো এ প্রশ্নের জবাবে সচিব স্বজল চন্দ্র দত্ত বলেন, এবিষয় আমি জানি না। নিবন্ধন করার কাজ আমার না। এটা উদ্যোক্তা করে থাকে। তবে বিষয়টি আমি দেখছি। (মুল কপির ফটোকপি আমাদের কাছে সংরক্ষিত আছে)
এডভোকেট ফজল আহমেদ এই প্রতিবেদককে জানান, একই নম্বরে দুইজন ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন থাকলে এটা স্বেচ্ছায় করা হয়েছে। আর এধরণের সরকারের সার্ভার নিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতি করা দণ্ডনিয় অপরাধ। যে কেউ সরকারের সার্ভার বা সরকারের কোন নথি পরিবর্তন করা ৪৬৬ ধারায় অপরাধী সাব্যস্থ হবে। আর এ ধারায় সর্বনিম্ন ৫ বছরের কারাদণ্ড।
বিষয়টি নিয়ে এসএম ফখরুদ্দীন আহম্মদ সাজিব জানান, আমার ইউনিয়নের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন, নাগরিক সনদ, চারিত্রিক সনদ বানিয়ে হুজুর কাজী নিয়োগে আবেদন করলে আমি নুর মোহাম্মদকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করি। চেয়ারম্যানকে আমি আসামী করিনি। কিন্তু চেয়ারম্যান ইউনিয়নের স্বার্থ ভুলে গিয়ে বহিরাগত হুজুরকে বাঁচাতে তার পক্ষ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। কিভাবে ইউনিয়নের কাগজপত্র বা জন্ম নিবন্ধন নুর মোহাম্মদ বানিয়েছে তা জিজ্ঞেস না করে মামলা তুলে নেয়ার জন্য আমাকে দিচ্ছে হুমকি-ধমকি। এতে বুঝাযায়, চেয়ারম্যান ও ইউপি সচিব জাল সনদ বানানোর পিছনে পরোক্ষভাবে জড়িত। এখন যেহেতু বিষয়টি আইনী পক্রিয়াধীন রয়েছে, আমি আশা করি আইনীভাবে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দুষিদের শাস্তি হবে।
১১ নং ব্রাহ্মণডুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হোসেইন মুহাম্মদ আদিল জজ মিয়ার সাথে মুঠো ফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এব্যাপারে হবিগঞ্জ স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, একই নাম্বারে দুইজন ব্যক্তির জন্ম নিবন্ধন সম্ভব নয়। ভুলক্রটি থাকলে আবেদনের মাধ্যমে তা সংশোধন করা সম্ভব। কিন্তু নাম্বার এক রেখে দুইজনকে দেয়া একটি প্রতারণ। তবে এব্যাপারে কেউ অভিযোগ দিলে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

Title