নিজস্ব প্রতিবেদক : পাল্টে গেছে দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। রাজনৈতিক কর্মকান্ড চলছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ সব দলের রাজনৈতিক কর্মকান্ডই এখন চলছে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে। নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে মতবিনিময় সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচী ভার্চুয়াল পদ্ধতিতেই পালন করছে রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজপথে নিয়মিত সমাবেশ, মিছিল, মানববন্ধন ও ইস্যুভিত্তিক হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী নিয়ে ব্যস্ত থাকাই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট। মাঝেমধ্যে সরকারী ও বিরোধী দল পাল্টা কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে কখনও কখনও রাজপথ উত্তপ্ত হয়। দীর্ঘকাল ধরে এমনই ছিল দেশের রাজনীতি। দেশে করোনা মহামারী শুরুর পর থেকেই মাঠের রাজনীতির ছন্দপতন ঘটে। ছোট বড় সব রাজনৈতিক দলই ডিজিটাল মাধ্যমে সরব হয়। কখনও কখনও ডিজিটাল মাধ্যমেই এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে। সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে, আলোচনা সভা, সেমিনার, মতবিনিময় ও দলীয় বিবৃতিসহ সকল কর্মকা- এখন ডিজিটাল মাধ্যমেই হচ্ছে। এর ফলে করোনা পরিস্থিতিতে ঘরে বসেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে রাজনৈতিক দলের নেতারা সহজেই বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে পারছেন। এতে সময় ও অর্থ খরচও কমে গেছে।
যারা এতদিন প্রযুক্তির এই সুবিধগুলো বুঝে উঠতে পারেননি তারাও এখন শিখে নিচ্ছেন ইন্টারনেট, জুম, ওয়েবিনার, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ ইত্যাদি। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশও একদিন সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ রাখবে ডিজিটাল গণমাধ্যমে। কমবে মাঠ ঘাটের অসুস্থ প্রতিযোগিতার রাজনীতি। কমবে রাজনৈতিক সহিংসতা।
৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর এক পর্যায়ে অন্যান্য দেশের মতো করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিলে জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে মানুষ ঘরবন্দী জীবন শুরু করে। জননিরাপত্তার স্বার্থে সরকারী ঘোষণায় ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হয়। এ সময় থেকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে মাঠের রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরে ডিজিটাল মাধ্যমে। কয়েক মাস পর থেকে সীমিত আকারে মাঠের কর্মসূচী চালু হলেও ডিজিটাল পদ্ধতিতে রাজনৈতিক কর্মসূচী ক্রমেই জোরদার হতে থাকে।
মে মাস পর্যন্ত দেশে চিকিৎসাসেবাসহ জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের না হলেও জুন মাস থেকে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ আস্তে আস্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করেন। তখন ডিজিটাল রাজনীতির পাশাপাশি মাঠের রাজনীতি সীমিত আকারে চালু হয়। দিন যত যেতে থাকে ডিজিটাল রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন ততই জোরদার হতে থাকে। বর্তমানে বড় রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্র থেকে শুরু করে সর্বস্তরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়মিত রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করছে। ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও বসে নেই। মাঝে মাঝে তারাও ডিজিটাল মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে। এর ফলে দেশের সর্বস্তরে ডিজিটাল রাজনীতি চাঙ্গা হয়।
দেশে করোনাভাইরাসের আক্রমণে এ পর্যন্ত সোয়া ৩ লাখ মানুষ আক্রান্ত ও প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ মারা গেলেও প্রাণঘাতী এ রোগ সম্পর্কে ভয় কেটে গেছে। তবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ইচ্ছে করলেও সবকিছু আগের মতো করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে মাঠের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে জনসমাগম হয় বিধায় এতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই কবে আবার মাঠের রাজনীতি পুরোদমে শুরু হবে তা নির্ভর করছে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। তবে যতদিন না মাঠের রাজনীতি পুরোদমে শুরু হবে ততদিন পর্যন্ত ডিজিটাল রাজনীতি নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যস্ত থাকতে হবে।
বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো ডিজিটাল মাধ্যমেই দল পুনর্গঠনসহ সার্বিক কর্মকা- অব্যাহত রেখেছে। এজন্য অনলাইনে লাইভে এসে বক্তব্য প্রচারসহ বিভিন্নভাবে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ করে রাজনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিদিনই একাধিক কর্মসূচী পালন করে থাকে ডিজিটাল মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিদিনই গণভবন থেকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে দলীয় কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে নেতাকর্মীদের সামনে বক্তব্য রাখেন। একইভাবে তিনি কেবিনেট মিটিংসহ সরকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। এছাড়া করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে দেশের উন্নয়নে কাজ করছেন। আর সাময়িক মুক্তি নিয়ে গুলশানের বাসায় অবস্থান করা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কৌশলগত কারণে রাজনীতি থেকে আপাতত দূরে রয়েছেন। তবে তিনি ডিজিটাল মাধ্যমে স্বজন ও দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাদের মতো বিভিন্ন দলের সিনিয়র নেতারাও নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে নিয়মিত সর্বস্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রতিক কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় সরকারী দল আওয়ামী লীগ ডিজিটাল রাজনীতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সরব। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলের অধিকাংশ নেতাই ডিজিটাল রাজনীতিতে বেশি সক্রিয়। এছাড়া সারাদেশেই দলের বিভিন্ন ইউনিট ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সীমিত আকারে মাঠের কর্মসূচীর পাশাপাশি ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিভিন্ন কর্মসূচী পালনে ব্যস্ত রয়েছেন।
জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপি, জাসদ (ইনু), জাসদ (রব), ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, বিকল্পধারা, বিজেপি, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) গণফোরাম ও নাগরিক ঐক্য, এলডিপি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, কল্যাণ পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিসহ ছোট-বড় ক’টি রাজনৈতিক দলই এখন ডিজিটাল পদ্ধতিতে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। এসব দল নিয়মিতই বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করছে। কখনও বা জুম মটিং করে নেতাকর্মীদের বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছে। নাম সর্বস্ব ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলো করোনা পরিস্থিতির পর প্রথমে চুপ থাকলেও এখন বিভিন্ন ইস্যুতে ভার্চুয়াল সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করছে। দেশে করোনা ও বন্যার পর ডিজিটাল পদ্ধতিতে ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীও বিতরণ করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ যাবত ৬ কোটি মানুষের মাঝে উপহার ও আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে। দেশের আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের মাঝে শেখ হাসিনার এ মানবিক সহায়তার কারণে সারাদেশের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর মধ্যে নিজ দলের সভানেত্রী সম্পর্কে আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। খালেদা জিয়ার নির্দেশে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীও আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের মাঝে ডিজিটাল মাধ্যমে সীমিত পরিসরে হলেও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছেন। জাতীয় পার্টি ও বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দলগুলো করোনাকালে অসহায় মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিতরণসহ ডিজিটাল রাজনীতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত কাজ করছে।