দেশে কভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয়ভাবে টিকাদানের খসড়া পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই খসড়াটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর এটি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হবে। খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন পর্যায়ে পাঁচটি ধাপে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশ টিকার আওতায় আসবে। যা মোট জনসংখ্যার হিসাবে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার জন। এই জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯২ দিন। সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে কম ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খসড়া পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সমকালকে বলেন, খসড়া পরিকল্পনাটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন সেখানে যাচাই-বাছাই অর্থাৎ সংযোজন-বিয়োজনসহ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এটি চূড়ান্ত করা হবে। তবে কবে নাগাদ এটি চূড়ান্ত হবে, সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারেননি তিনি। ১৮ বছরের নিচে থাকা ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠী, ৩০ থেকে ৩৫ লাখ প্রসূতি এবং বিদেশে থাকা ১ কোটিসহ প্রায় ছয় কোটি মানুষ টিকার আওতার বাইরে থাকবে- শুরু থেকে এমন তথ্য জানানো হয়েছিল। তাহলে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ কীভাবে টিকা প্রাপ্তির খসড়া পরিকল্পনায় যুক্ত হলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আলমগীর বলেন, ফাইজার-বায়োএনটেক, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ইতোমধ্যে শিশু ও প্রসূতিদের ওপর ট্রায়াল শুরু হয়েছে। তারাও হয়তো টিকার আওতায় আসতে পারেন। এ ছাড়া টিকাদান শেষ হওয়ার আগেই ১৮ বছরের নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের বয়স ১৮ বছর অতিক্রম করবে। এসব চিন্তা করেই দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশকে টিকার আওতায় এনে খসড়া পরিকল্পনা করা হয়েছে।
টিকার আওতায় আসবে প্রায় ১৪ কোটি মানুষ :খসড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে মোট জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশ বা ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জনকে টিকা দেওয়া হবে। দ্বিতীয় ধাপে ৭ শতাংশ বা এক কোটি ২০ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৭ জন টিকা পাবেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি ধাপে ১১ থেকে ২০ শতাংশ বা এক কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার মানুষ টিকা পাবেন। তৃতীয় ও সর্বশেষ পর্যায়ে মোট দুটি ধাপে টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২১ থেকে ৪০ শতাংশ বা ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৬১ হাজার এবং দ্বিতীয় ধাপে ৪১ থেকে ৫০ শতাংশ বা ৬ কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে কভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা টিকার আওতায় আসবেন। দ্বিতীয় ধাপে বয়স্ক, স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে এমন বয়স্ক মানুষ, শিক্ষাকর্মী ও গণপরিবহনের কর্মীদের টিকার আওতায় আনা হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের টিকার আওতায় আনা হবে।
টিকা পাবেন যারা :প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে কভিড-১৯ মোকাবিলায় যুক্ত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা এবং সমাজকর্মীরা টিকার আওতায় আসবেন। তাদের সংখ্যা তিন শতাংশ বা ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৮২ জন। এই তিন শতাংশের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, নার্স এবং মিডওয়াইফারি পেশায় নিয়োজিত কর্মী, মেডিকেল ও প্যাথলজি ল্যাব কর্মী, পেশাদার স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্ন কর্মী, সাইকোথেরাপির সঙ্গে সংশ্নিষ্ট, মেডিসিন পারসোনেল, কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, অ্যাম্বুলেন্স চালক মিলে তিন লাখ ৩২ হাজার জন। সব সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী যারা স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ধাপে কাজ করলেও সরাসরি কভিড-১৯ মোকাবিলার সঙ্গে যুক্ত নন যেমন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কর্মী, বাণিজ্য কর্মী, লন্ড্রি কর্মী, অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি অন্যান্য গাড়ি চালক- এমন এক লাখ ২০ হাজার জনকে টিকা দেওয়া হবে। এ ছাড়া ২ লাখ ১০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, ৫ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, আনসার, ভিডিপিসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সেনাবাহিনী, নেভি, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র?্যাব, কোস্টগার্ড ও প্রেসিডেন্ট গার্ডের তিন লাখ ৬০ হাজার সদস্য, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের ৫০ হাজার কর্মকর্তা, ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা সাংবাদিক, মিডিয়াকর্মী ৫০ হাজার জনকে টিকার আওতায় আনা হবে। এর বাইরে এই ধাপে জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কর্মী. ধর্মীয় নেতা, দাফন ও সৎকারে নিয়োজিত কর্মী, ওয়াসা, ডেসা, তিতাস ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মী, স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, প্রবাসী শ্রমিক, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মী, ব্যাংক কর্মী, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম- এমন রোগী, রোহিঙ্গা, বাফার, জরুরি ও মহামারি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীরা টিকার আওতায় আসবেন। প্রথম পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে টিকা দেওয়া হবে ৬০ বছর বা এর চেয়ে বয়স্ক নাগরিকদের।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী নাগরিক, বয়স্ক এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা মানুষ, শিক্ষক, সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মী, প্রথম পর্যায়ে বাদ পড়া গণমাধ্যম কর্মী, দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী মানুষ, আদিবাসী সম্প্রদায়ের সদস্য, গণপরিবহন কর্মী, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ওষুধের দোকানের কর্মী, গার্মেন্ট শ্রমিক, যৌনকর্মী ও তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা টিকার আওতায় আসবেন।
তৃতীয় পর্যায়ের প্রথম ধাপে দ্বিতীয় ধাপে টিকা পাননি এমন শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, প্রসূতি, অন্যান্য সরকারি কর্মচারী, অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী কর্মী, অন্যান্য স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী, রপ্তানি ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মী, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বন্দর কর্মী, কয়েদী ও জেলকর্মী, শহরের বস্তিবাসী বা ভাসমান জনগোষ্ঠী, কৃষি ও খাদ্য সরবরাহের কাজে নিয়োজিত কর্মী, ডরমিটরির বাসিন্দা, গৃহহীন জনগোষ্ঠী, অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মী, বাদ পড়া গণপরিবহন কর্মী, বাদ পডা ৫০ থেকে ৫৪ বছর বযসী নাগরিক, জরুরি ও মহামারি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্মীরা টিকা পাবেন।
তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় ধাপে অর্থাৎ সর্বশেষ ধাপে টিকা পাবেন বাদ পড়া যুব জনগোষ্ঠী, শিশু ও স্কুলগামী শিক্ষার্থী এবং আগের বাদ পড়া সব জনগোষ্ঠী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, খসড়া পরিকল্পনাটি দ্রুততার সঙ্গে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। কোনো কিছু সংযোজন কিংবা বিয়োজন করতে হলে তা দ্রুত করতে হবে। আশা করি মন্ত্রণালয় বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সবার সঙ্গে আলোচনা করে এটি চূড়ান্ত করবে।
খসড়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, টিকাদান কর্মসূচি পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং পর্যবেক্ষণে সহায়তা ও সমন্বয়ের জন্য সরকারের সব পর্যায়ের পরিকল্পনা ও সমন্বয়ক কমিটি গঠন করা হবে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর টিকাদানের জন্য জাতীয় পর্যায়ে পৃথক কমিটি গঠন করা হবে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া বাকি দিনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত টিকাদান কর্মসূচি চলবে। সরকারি ছুটির দিনে বিশেষ পরিকল্পনার আওতায় সরকার নির্ধারিত কিছু টিকাদান কেন্দ্রে সন্ধ্যায় টিকাদান কার্যক্রম চালানো যাবে। দু’জন টিকাদান কর্মী ও চারজন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে মোট ছয়জন করে একেকটি দল তৈরি করা হবে, যারা মাঠ পর্যায়ের কেন্দ্রগুলোতে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করবেন। প্রত্যেকটি দল প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ জনকে টিকা দিতে পারবে বলে খসড়া পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় রেফ্রিজারেটর ট্রাকে করে টিকা পরিবহন করবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে টিকাদানের একটি খসড়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। যে কোনো খসড়া পরিকল্পনা চূড়ান্ত পরিকল্পনা নয়। খসড়ার মধ্যে সংযোজন-বিয়োজন হয়। এর পরই এটি চূড়ান্ত হয়। সুতরাং টিকাদানের খসড়া পরিকল্পনাটি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পর্যালোচনা করবেন। এর পর টিকাদান পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত হবে। কবে নাগাদ টিকাদানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত করে কিছু বলেননি। তবে দ্রুতই টিকাদান পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে বলে জানান মন্ত্রী।